![]()
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) রাত্রির আকাশে শুক্রবার ভেসে উঠেছিল উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা এবং দীর্ঘদিনের জমে থাকা আশা। রাত ৯টায় উপাচার্য অধ্যাপক ড. এ এম সারওয়ারউদ্দিন চৌধুরীর কণ্ঠে ঘোষিত এক বাক্য যেন সারা ক্যাম্পাসের প্রাণ ফিরিয়ে দিল—“আগামী ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হবে শাকসু নির্বাচন।”
মাত্র একটি ঘোষণা, কিন্তু তার ওজন ২৮ বছরের ইতিহাস, স্মৃতি, সংকট ও সংগ্রামের সাথে ধরা। শাবির নতুন শিক্ষার্থী থেকে পুরোনো প্রাক্তনরা—সবাই জানতেন, এই নির্বাচন শুধু একটি শিক্ষার্থী সংসদ নির্বাচন নয়; এটি একটি আবেগ, একটি অধিকার, এবং দীর্ঘদিন অবদমিত থাকা গণতান্ত্রিক চর্চার পুনর্জন্ম।
স্থগিত সংবাদ সম্মেলন, রাতের আঁধারে ক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীদের অবস্থান
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার কথা ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে সংবাদ সম্মেলন স্থগিত হওয়ায় ক্ষোভে ফেটে পড়েন শিক্ষার্থীরা। তরুণেরা যেন তাদের দমিয়ে রাখা অধিকার আবারও হাতছাড়া হতে দেখেছিলেন।
সন্ধ্যার পর থেকেই ধীরে ধীরে জড়ো হতে থাকে শত শত শিক্ষার্থী। রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে মানবিক চাপা কণ্ঠে ভেসে আসছিল একটাই প্রশ্ন—“আর কত দিন অপেক্ষা?”
অবস্থানে ছিলেন প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীও, ছিলেন গবেষক, হলের প্রতিনিধিরা—সবার অভিজ্ঞতা ভিন্ন হলেও দাবির জায়গা একই—নির্বাচন চাই, এখনই চাই।
রাত ১০টার দিকে প্রশাসনিক ভবনে তালা দেওয়া হয়। টানটান উত্তেজনার মধ্যে শিক্ষার্থীরা উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান নেন। বৃষ্টি, ক্লান্তি, ক্ষুধা—সব পেরিয়ে তারা দাঁড়িয়ে ছিলেন একটি অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য।
রাতের নিস্তব্ধতা ভাঙেন প্রশাসনের শীর্ষ কর্মকর্তারা
রাত ১১টার দিকে এসে কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. ইসমাইল হোসেন এবং প্রক্টর অধ্যাপক মোখলেসুর রহমান পরিস্থিতি শান্ত করতে চেষ্টা করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মন জুড়ে ছিল অনিশ্চয়তার ঘন কুয়াশা—মুখে ‘আশ্বাস’ শব্দটি আর তেমন কাজ করছিল না।
রাত বাড়তে থাকে—ঘড়ির কাঁটা যখন রাত ১টা স্পর্শ করে, তখন উপস্থিত হন উপাচার্য ও উপ-উপাচার্য।
তাদের কথায় শিক্ষার্থীরা অনুভব করেন পরিস্থিতি সত্যিই পরিবর্তন হচ্ছে।
উপাচার্যের কণ্ঠে একাত্মতার সুর—
“নির্বাচন কমিশন স্বাধীনভাবে কাজ করবে। আমরা হস্তক্ষেপ করবো না। ১০ ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন সম্পন্ন হবে।”
এই বাক্যগুলো শুধু একটি ঘোষণা নয়, ছিল এক ধরনের প্রতিশ্রুতি—শিক্ষার্থীদের প্রতি, ক্যাম্পাসের প্রতি, এবং ভবিষ্যতের প্রতি।
নতুন গঠনতন্ত্র, নতুন ওয়েবসাইট—নতুন যাত্রার শুরু
এদিকে নির্বাচনের গঠনতন্ত্রসহ পুরো প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছ করার লক্ষ্যে নির্বাচন কমিশনের নিজস্ব ওয়েবসাইটও উদ্বোধন করা হয়েছে।
এটি শুধু একটি প্রযুক্তিগত পদক্ষেপ নয়—বরং একটি নতুন যুগের সূচনা, যেখানে শিক্ষার্থীদের ভোট, মতামত ও অধিকার আরও সংগঠিত, আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরছে।
শিক্ষার্থীদের চোখে এটি শুধু নির্বাচন নয়—একটি পুনর্জাগরণ
২৮ বছর পর এই নির্বাচন মানে এক প্রজন্ম নয়, অন্তত তিন প্রজন্মের শিক্ষার্থীর স্বপ্নপূরণ।
যেসব প্রাক্তন শিক্ষার্থী এখানে পড়েছেন, আজ তারা হয়তো দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে আছেন। তাদের সময়েও শাকসু হয়নি।
অতএব, এই নির্বাচন পূর্ববর্তী সব প্রজন্মের জন্যই এক ধরনের ঐতিহাসিক মুক্তি।
হাসিমুখে, উদ্বেগে, উচ্ছ্বাসে একেকজন শিক্ষার্থী বলছিলেন—
“আমরা চাই আমাদের কণ্ঠ শোনা যাক।”
“ক্লাব, সংস্কৃতি, খেলাধুলা—সবকিছুতে আবার নতুন প্রাণ ফিরুক।”
“সুশাসনের প্রথম শর্ত হলো গণতান্ত্রিক অংশগ্রহণ।”
শাবিতে এখন নতুন ভোরের অপেক্ষা
আগামী ১৭ ডিসেম্বর নির্বাচন মানে শুধু ভোট নয়—একটি নতুন ভোরের আগমনী সুর।
যেখানে শিক্ষার্থীরা নিজেরা নিজের প্রতিনিধিকে বেছে নেবেন, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয় আবার ফিরে পাবে তার হারানো গণতান্ত্রিক রূপ।
বহুদিনের ধুলোমলিন স্মৃতির পাতা খুলে আবার লেখা হবে নতুন শুরুর গল্প।
এ গল্প শাবির, এ গল্প তরুণদের, এ গল্প সকলের যে গল্প বিশ্বাস করে—
যত বাধাই আসুক, অধিকার কখনো চিরতরে হারিয়ে যায় না।
পাঠকের মন্তব্য