![]()
বাংলাদেশ এখন এক গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আছে। তিনটি বিতর্কিত ও কথিত কারচুপি হওয়া নির্বাচনের পর দেশ আবার প্রস্তুত হচ্ছে একটি নতুন জাতীয় নির্বাচনের জন্য।
তবে নির্বাচনের উত্তাপের আগেই দুটি ঘটনাকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে তুমুল আলোচনা—
একটি হলো জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমানের জনসমক্ষে ক্ষমা প্রার্থনা,
আরেকটি হলো অন্তর্বর্তীকালীন সরকারপ্রধান নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কিছু নীতিগত সিদ্ধান্ত।
এই দুই ঘটনাই নতুন করে প্রশ্ন তুলেছে—
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথ কি জবাবদিহিতা ও উদারনৈতিক রাষ্ট্রচেতনার,
নাকি ধর্মীয় প্রভাব ও রাজনৈতিক সুবিধাবাদের দিকে?
ক্ষমা না কৌশল? জামায়াতের ইতিহাসের মুখোমুখি হওয়া
দ্য ডিপ্লোম্যাট (৩ নভেম্বর ২০২৫)–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জামায়াতে ইসলামীর আমীর ড. শফিকুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের কাছে ১৯৪৭ সাল থেকে ঘটে যাওয়া সকল কষ্ট ও ভোগান্তির জন্য “নির্বিচারে ক্ষমা প্রার্থনা” করেছেন।
তবে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, এই ক্ষমা প্রার্থনায় ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকা নিয়ে কোনো সরাসরি দায় স্বীকার করা হয়নি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এটি মূলত একটি “কৌশলগত ক্ষমা”—অতীতের দায় মুছে নতুন করে মূলধারার রাজনীতিতে প্রবেশের প্রচেষ্টা।
কিন্তু অস্পষ্ট ভাষা ও ইতিহাসের প্রতি দ্ব্যর্থ মনোভাব এই ক্ষমা প্রার্থনাকে অনেকের চোখে বিশ্বাসযোগ্য নয়, বরং বিভ্রান্তিকর করে তুলেছে।
বিশেষত তরুণ প্রজন্ম, যারা তথ্যপ্রযুক্তি ও মুক্ত ইতিহাসচর্চার যুগে বেড়ে উঠেছে, তারা এই ক্ষমাকে দেখছে “রাজনৈতিক সুবিধার জন্য ইতিহাস পুনর্লিখনের চেষ্টা” হিসেবে।
নারীর কর্মঘণ্টা কমানোর প্রস্তাব: সহানুভূতি না সীমাবদ্ধতা
এই সময়েই জামায়াত নেতৃত্ব নারীদের দৈনিক কর্মঘণ্টা আট ঘণ্টা থেকে কমিয়ে পাঁচ ঘণ্টা করার প্রস্তাব দেয়।
তারা একে কর্মজীবী মায়েদের জন্য সহানুভূতির উদ্যোগ হিসেবে উপস্থাপন করেছে।
তবে নাগরিক সমাজ, নারী অধিকার সংগঠন, পেশাজীবী মহল ও একাডেমিক গবেষকরা এই প্রস্তাবকে “নারীর ক্ষমতায়নের বিরুদ্ধে একটি পশ্চাৎমুখী পদক্ষেপ” বলে আখ্যা দিয়েছেন।
বাংলাদেশের উন্নয়নের অভিজ্ঞতা প্রমাণ করেছে—
সমান সুযোগ, শিশুর যত্নকেন্দ্র এবং নিরাপদ কর্মপরিবেশ নারীদের অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের মূল চালিকাশক্তি।
কর্মঘণ্টা কমালে নারীরা শ্রমবাজারে দুর্বল অবস্থানে পড়বেন, আয় কমবে এবং দীর্ঘমেয়াদে তাদের অর্থনৈতিক স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে।
নারী অধিকারকর্মীরা বলছেন—
“নীতিগত সংস্কার ক্ষমতায়নমূলক হতে হবে, সীমাবদ্ধতামূলক নয়।”
ইউনূস সরকারের নীতিগত ভারসাম্য নিয়ে বিতর্ক
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নেতৃত্বে থাকা নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রশাসনও সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে সমানভাবে আলোচিত।
ফার্স্টপোস্ট (নভেম্বর ২০২৫)–এর প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকার ধর্মীয় গোষ্ঠীর চাপের মুখে সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা বিষয়ে নতুন শিক্ষক নিয়োগ পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে।
এই সিদ্ধান্ত ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষা নীতি ও সংস্কৃতির বহুত্ববাদ নিয়ে গভীর প্রশ্ন তুলেছে।
শিক্ষাবিদদের মতে, সংগীত ও শারীরিক শিক্ষা কেবল সাংস্কৃতিক অনুশীলন নয়; এগুলো সৃজনশীলতা, দলগত কাজ, আবেগীয় বুদ্ধিমত্তা ও শৃঙ্খলা শেখানোর গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
এসব বাদ দিলে তরুণ প্রজন্মের মানসিক বিকাশ ও সামাজিক ঐক্যে স্থায়ী ক্ষতি হতে পারে।
একজন শিক্ষাবিদ মন্তব্য করেছেন—
“সংগীত ও খেলাধুলা থেকে বঞ্চিত একটি প্রজন্ম কেবল জ্ঞান হারাবে না, তারা হারাবে মানবিক সংবেদনশীলতাও।”
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ পথ: জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভুক্তির দিকে
বাংলাদেশ গত পাঁচ দশকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নারীর ক্ষমতায়ন ও দারিদ্র্য হ্রাসে যে অর্জন করেছে, তার ভিত্তি হলো বহুত্ববাদ ও মধ্যপন্থার চেতনা।
আজ যখন পুরোনো বিভাজনগুলো নতুন আকারে ফিরে আসছে, তখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো—
গণতান্ত্রিক জবাবদিহিতা, লিঙ্গসমতা ও ধর্মনিরপেক্ষতার পুনর্নবীকরণ।
ক্ষমা তখনই অর্থবহ, যখন তা দায় স্বীকারের সঙ্গে আসে।
সংস্কার তখনই টেকসই, যখন তা অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।
আর শাসন তখনই স্থিতিশীল, যখন তার ভিত্তি হয় ন্যায়, সমতা ও মানবিক মর্যাদা।
বাংলাদেশ এখন এমন নেতৃত্বের অপেক্ষায়, যে নেতৃত্ব অতীতের বোঝা নয়, বরং ভবিষ্যতের ঐক্য, ন্যায় ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ে তুলবে।
পাঠকের মন্তব্য