![]()
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় ন্যায়বিচারের একটি নতুন অধ্যায় যুক্ত হলো আজ। দীর্ঘ রাজনৈতিক ও সামাজিক আলোচনার পর, সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা মামলায় সাবেক মন্ত্রী আবদুল লতিফ সিদ্দিকী এবং সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলমকে অন্তর্বর্তীকালীন জামিন দিয়েছেন হাইকোর্ট।
এই সিদ্ধান্তে শুধু দুটি মানুষ নয়, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের প্রতি বিশ্বাসও যেন নতুন করে ফিরে এসেছে— এমনটাই বলছেন পর্যবেক্ষকরা।
আদালতের আদেশ ও আইনি প্রক্রিয়া
বৃহস্পতিবার (৬ নভেম্বর) পৃথক দুটি জামিন আবেদনের শুনানি শেষে বিচারপতি এ এস এম আবদুল মোবিন ও বিচারপতি মো. সগীর হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ রুলসহ জামিন মঞ্জুর করেন।
আদালতে লতিফ সিদ্দিকীর পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না, ফজলুর রহমান ও এম আবদুল্লাহ আল হারুন ভূঁইয়া।
অন্যদিকে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলমের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করেন সারা হোসেন, রমজান আলী শিকদার এবং প্রিয়া আহসান চৌধুরী।
রাষ্ট্রপক্ষে শুনানিতে অংশ নেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল সুলতানা আক্তার রুবী।
আইনজীবীরা বলেন, আদালতের এই সিদ্ধান্তে তাঁদের মক্কেলদের কারামুক্তিতে কোনো আইনি বাধা নেই, যদি রাষ্ট্রপক্ষ নতুন কোনো পদক্ষেপ না নেয়।
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টি
আবদুল লতিফ সিদ্দিকী— একসময় জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়, পরবর্তীতে নানা বিতর্কে আলোচনায় আসা এক নাম। অন্যদিকে সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম— গণমাধ্যমে সত্য তুলে ধরার প্রয়াসে নিরলস একজন পেশাজীবী।
তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা— যা নিয়ে দেশজুড়ে প্রশ্ন উঠেছিল, বক্তব্য দেওয়ার কারণে কাউকে সন্ত্রাসবিরোধী মামলায় অভিযুক্ত করা কতটা ন্যায়সঙ্গত?
আজকের হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত তাই শুধু আইনি নয়, মানবাধিকারের পক্ষেও একটি প্রতীকী বার্তা:
“মতপ্রকাশের স্বাধীনতা কখনো অপরাধ হতে পারে না।”
ঘটনাপ্রবাহের সংক্ষিপ্ত পটভূমি
গত ২৮ আগস্ট সকাল। রাজধানীর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ‘আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং বাংলাদেশের সংবিধান’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনা। আয়োজক ছিল ‘মঞ্চ ৭১’ নামে একটি সংগঠন।
সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে ড. কামাল হোসেনের নাম থাকলেও তিনি উপস্থিত ছিলেন না। আলোচনায় বক্তব্য রাখেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধ্যাপক শেখ হাফিজুর রহমান কার্জন।
তার বক্তব্যের পরপরই একদল ব্যক্তি প্রবেশ করে ‘জুলাইয়ের হাতিয়ার, গর্জে উঠুক আরেকবার’, ‘লীগ ধর, জেলে ভর’ ইত্যাদি স্লোগান দিতে শুরু করে। মুহূর্তেই সভাস্থল অরাজকতায় পরিণত হয়।
পরে পুলিশের হস্তক্ষেপে উপস্থিত কয়েকজনকে আটক করা হয়— তাদের মধ্যে ছিলেন আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অধ্যাপক হাফিজুর রহমান ও সাংবাদিক মঞ্জুরুল আলম।
রাত পৌনে একটার দিকে শাহবাগ থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে মামলা দায়ের করা হয়— মোট ১৬ জনকে আসামি করে।
সমাজে প্রতিক্রিয়া
এই গ্রেপ্তারের পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও নাগরিক মহলে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। অনেকেই মনে করেন, এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত এবং দেশের মানবাধিকার চর্চার জন্য একটি অশনি সংকেত।
হাইকোর্টের এই জামিনাদেশ তাই জনমনে স্বস্তি ও আশার বার্তা হিসেবে এসেছে।
ন্যায়বিচারের পথে এক মানবিক দৃষ্টান্ত
বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার ইতিহাসে অনেক সময় রাজনৈতিক মামলাগুলো মানবিক দৃষ্টিকোণ হারিয়ে ফেলে। কিন্তু লতিফ সিদ্দিকী ও মঞ্জুরুল আলমের জামিন দেখালো—
যখন আদালত স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন আইনের শাসনই হয় চূড়ান্ত আশ্রয়।
এটি কেবল দুইজন নাগরিকের মুক্তি নয়, এটি একটি দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনর্নির্মাণের প্রতীক।
পাঠকের মন্তব্য