জাহিদ ইউ সৈয়দ
ট্রাম্প প্রশাসনের নতুন ট্যারিফ, চীন-মার্কিন প্রতিদ্বন্দ্বিতা, ভারতের লজিস্টিক সীমাবদ্ধতা এবং বাংলাদেশ-চীন অর্থনৈতিক সম্পর্ক—সব মিলিয়ে বাংলাদেশ এখন বৈশ্বিক বাণিজ্য রাজনীতির কেন্দ্রে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক (RMG) শিল্প শুধু একটি রপ্তানি খাত নয়—এটি দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, যেখানে ৪০ লাখেরও বেশি মানুষ কর্মরত, যার মধ্যে ৮০% নারী। কিন্তু ২০২৫ সালে এসে এই শিল্পটি নতুন এক বাস্তবতার মুখোমুখি। একদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী ট্যারিফ নীতি, অন্যদিকে চীন-মার্কিন ভূ-রাজনৈতিক উত্তেজনা, ভারতের ট্রানজিট নিষেধাজ্ঞা ও আঞ্চলিক সরবরাহ ব্যবস্থার সংকট সব মিলিয়ে একটি বহুমাত্রিক চাপ সৃষ্টি হয়েছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের ট্যারিফ এবং মার্কিন বাজারে অনিশ্চয়তা
ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে ফিরে আসার পর বাংলাদেশের পণ্যের উপর ৩৭% পর্যন্ত রেসিপ্রোকাল ট্যারিফ বসানো হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত শুধুই আর্থিক বোঝা নয়; এটি একটি রাজনৈতিক বার্তা—যুক্তরাষ্ট্র চায় আরও “ব্যালান্সড ট্রেড”। ফলে, মার্কিন বাজারে বাংলাদেশের প্রতিযোগিতা এখন চীন, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার সঙ্গে।
বিশ্ব রাজনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান: বন্ধন না বিপত্তি?
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের প্রতি কৌশলগত আগ্রহ দেখালেও একইসঙ্গে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত সম্পর্ক গভীর করছে। যেমন, চীন বাংলাদেশের ৯৭% পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা দিয়েছে। যদিও এটি স্বস্তির খবর, তবে এতে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিও পাল্টাচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন কৌশলগতভাবে এক ‘ভারসাম্যপূর্ণ কূটনৈতিক নীতির’ দিকে যাচ্ছে—যা কেবল অর্থনীতির জন্য নয়, ভবিষ্যতের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ।
লজিস্টিক সংকট ও আঞ্চলিক ট্রানজিট রাজনীতি
ভারতের হঠাৎ করে বাংলাদেশি পণ্যের ট্রানজিট সুবিধা প্রত্যাহার কেবল অর্থনৈতিক খরচ বাড়ায়নি, বরং আঞ্চলিক বাণিজ্যে বাংলাদেশের অবস্থানকেও নড়বড়ে করে তুলেছে। এখন বাংলাদেশের সামনে একটি সুযোগ এসেছে—চীন-মিয়ানমার-বাংলাদেশ করিডোর, কিংবা নিজস্ব বন্দর ও বিমানবন্দরকে আরও কার্যকর করার মাধ্যমে বিকল্প তৈরি করা।
ESG, পরিবেশ ও শ্রমমান—ভবিষ্যতের বিশ্বে টিকে থাকার শর্ত
সাম্প্রতিককালে ইউরোপ ও আমেরিকান ক্রেতারা আরও সচেতন হচ্ছে ESG (Environmental, Social, Governance) মান নিয়ে। বাংলাদেশের পোশাক খাত আগে থেকেই গ্রিন ফ্যাক্টরি, নিরাপত্তা ও শ্রমিক কল্যাণে অগ্রণী থাকলেও এখন আরও শক্তিশালী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো গড়ার সময় এসেছে।
করণীয় ও সুপারিশসমূহ:
দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি দ্রুত সম্পাদন: মার্কিন বাজারে GSP পুনর্বহালের দাবি এবং দক্ষিণ-দক্ষিণ বাণিজ্য বাড়ানো।
লজিস্টিক অবকাঠামো উন্নয়ন: চট্টগ্রাম ও পায়রা বন্দরের আধুনিকীকরণ ও রেলভিত্তিক সংযোগ বিস্তার।
উচ্চমানের শিল্প দক্ষতা উন্নয়ন: ডিজিটাল স্কিল, ফ্যাশন ডিজাইন ও আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণে প্রশিক্ষণ বাড়ানো।
নতুন বাজার খুঁজে বের করা: আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও ল্যাটিন আমেরিকার উদীয়মান অর্থনীতিতে প্রবেশ।
ESG রিপোর্টিং বাধ্যতামূলক করা: ট্রেসিবিলিটি ও সার্টিফিকেশন বাড়ানো।
উপসংহার
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত এখন আর কেবল উৎপাদন ও রপ্তানিকেন্দ্রিক খাত নয়; এটি একটি ভূ-রাজনৈতিক খেলোয়াড়। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ, কৌশলগত জোট ও ট্যারিফ প্রভাবের মধ্যে দেশটির জন্য সময় এসেছে ব্যবসায়িক কৌশলের সঙ্গে কূটনৈতিক প্রজ্ঞা মিলিয়ে এগোনোর।
এই অভিযোজনের নেতৃত্ব দিতে হবে সরকার, ব্যবসায়িক সংগঠন, এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারদের যৌথভাবে—যেখানে ‘কেবল টিকে থাকা’ নয়, ভবিষ্যতের জন্য স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধির ভিত্তি গড়া হবে মূল লক্ষ্য।