জাহিদ ইউ সৈয়দ
ভূমিকা
বিশ্বজুড়ে অর্থনীতির চাকা যেসব হাত ধরে ঘুরছে, তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তা (SMEs) খাত। ২০২৫ সালে এসে এই খাতটি শুধু কর্মসংস্থান বা প্রবৃদ্ধির উৎস নয়—বরং উদ্ভাবনের সূতিকাগার হয়ে উঠছে। ফোর্বস রিসার্চের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, উচ্চ প্রবৃদ্ধিসম্পন্ন ছোট ব্যবসাগুলোর মূল সাফল্য চারটি মৌলিক দিকের ওপর দাঁড়িয়ে—প্রযুক্তি গ্রহণ, গ্রাহককেন্দ্রিক উদ্ভাবন, টেকসইতা এবং আর্থিক শৃঙ্খলা।
এই প্রবন্ধে আমরা বিশ্বব্যাপী এই চারটি প্রবণতা বিশ্লেষণ করব, পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর বাস্তবায়ন ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরব।
১. প্রযুক্তি গ্রহণ: চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সুবিধা ছোটদের হাতেও
যে ব্যবসাগুলো প্রযুক্তিকে প্রথম থেকেই কৌশলগতভাবে কাজে লাগিয়েছে, তারাই ২০২৫ সালে দ্রুত এগিয়ে চলেছে। মোবাইল অ্যাপ, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), ক্লাউড-ভিত্তিক হিসাবরক্ষণ, এবং অটোমেশন—এসব প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহারে উৎপাদন খরচ কমেছে, গ্রাহক সেবা বেড়েছে এবং সময় বাঁচছে।
বাংলাদেশে বাস্তব উদাহরণ:
greenQube-EFARMER নামে একটি মোবাইল অ্যাপ ছোট কৃষকদের ডিজিটাইজ করছে, যা E-Farmers Bangladesh ও InQube Innoventures UK-এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত।
ডিজিটাল পল্লী প্রকল্পে প্রযুক্তিনির্ভর উদ্যোক্তা নারী, যিনি সৌরচালিত সেচপাম্প, মোবাইল ব্যাংকিং ও ই-কমার্সের মাধ্যমে কৃষককে যুক্ত করছেন জাতীয় অর্থনীতির মূলধারায়।
বিশ্বব্যাপী চিত্র: চীনের Taobao Villages বা আফ্রিকার M-Pesa ভিত্তিক ব্যবসাগুলোর র্যাপিড গ্রোথ মূলত এসেছে প্রযুক্তির কারণে।
২. গ্রাহক-কেন্দ্রিক উদ্ভাবন: সমস্যা সমাধানে সৃজনশীল পন্থা
২০২৫-এর ব্যবসা শুধু প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নিয়ে নয়, বরং কীভাবে তা গ্রাহকের জীবনকে সহজ করছে—তা নিয়েই। যে ব্যবসা দ্রুত সিদ্ধান্ত নেয়, প্রাসঙ্গিক থাকে এবং পরিবর্তনের সাথে তাল মিলায়, তারাই আজকের বিজয়ী।
উদাহরণ:
একজন নারী উদ্যোক্তা নিজের বাড়ির উঠোনে গরু পালন, সবজি চাষ ও মাশরুম উৎপাদনের পাশাপাশি একটি ফেসবুক পেজ চালাচ্ছেন, যেখানে সরাসরি অর্ডার নিচ্ছেন ও নিজেই ডেলিভারি দিচ্ছেন।
Shajgoj, বাংলাদেশের বিউটি-টেক প্ল্যাটফর্ম, গ্রাহকের পছন্দ অনুযায়ী রেকমেন্ডেশন ইঞ্জিন তৈরি করে চাহিদা অনুযায়ী পণ্য সরবরাহ করছে।
৩. টেকসইতা: লাভের সাথে দায়বদ্ধতা
পৃথিবী এখন এমন ব্যবসা চায় যারা শুধুমাত্র মুনাফার পেছনে ছুটে না, বরং পরিবেশ, সমাজ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সাথেও দায়িত্বশীল সম্পর্ক বজায় রাখে।
টেকসই ব্যবসার কিছু উদাহরণ:
SOLshare: বাংলাদেশের রুরাল গ্রিড-শেয়ারিং সিস্টেম চালু করেছে যেখানে সৌরবিদ্যুৎ একে অপরের সঙ্গে ভাগাভাগি করা যায়।
bKash বা Nagad যেমন কাগজের রসিদ ছাড়াই ডিজিটাল লেনদেনকে জনপ্রিয় করেছে, যা পরিবেশবান্ধবও বটে।
বিশ্বের উদাহরণ: Patagonia বা TOMS Shoes-এর মতো ব্র্যান্ডগুলো শুধু টেকসই পণ্যের কারণে নয়, সামাজিক দায়িত্বশীলতার কারণেও লাভবান।
৪. আর্থিক শৃঙ্খলা: অর্থের ভাষা বোঝা ও ব্যবহার শিখতে হবে
উন্নত ক্ষুদ্র ব্যবসাগুলো এখন শুধু আয় করলেই হয় না, বরং আয়, খরচ, ক্যাশফ্লো, প্রফিট মার্জিন ইত্যাদি সূচক বুঝতে হয়। অনেকেই এখন ফিনান্স অ্যাপ ব্যবহার করছেন যেমন:
TallyPrime
Wave
Zoho Books
এমনকি Google Sheets
বাংলাদেশে Win Incorporate ও E-Farmers কৃষকদের মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে হিসাবরক্ষণ শিখিয়ে দিচ্ছে। এই প্রক্রিয়ায় তারা ব্যাংকিং ও ঋণ প্রাপ্তিতেও সহজতা পাচ্ছে।
৫. অন্তর্ভুক্তি ও বৈচিত্র্য: নারী, যুব ও সংখ্যালঘুদের নেতৃত্ব
বিশ্বজুড়ে উচ্চ প্রবৃদ্ধি-সম্পন্ন ব্যবসাগুলোর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে—বৈচিত্র্যপূর্ণ নেতৃত্ব ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশগ্রহণ। বিশেষ করে নারীদের আর্থিক অন্তর্ভুক্তি এখন আর শুধু একটি “সহযোগী ভূমিকা” নয়, বরং তারা হয়ে উঠছেন চেঞ্জমেকার।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট: Poroshi ও iFarmer—সমাজ রূপান্তরের হাতিয়ার
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবসার অন্যতম অনন্য উদাহরণ ShopUp-এর Poroshi প্রকল্প। দিনাজপুর ও রংপুর অঞ্চলের শত শত নারী এই প্রকল্পের আওতায় প্রযুক্তির সহায়তায় পণ্য সরবরাহ, অর্ডার গ্রহণ ও স্থানীয় উদ্যোক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন। এই নারীরা এখন শুধু পরিবারের উপার্জনক্ষম সদস্য নন—তাঁরা গ্রামের শিশুদের অনুপ্রেরণা, পরিবারের আর্থিক পরামর্শদাতা এবং স্থানীয় উন্নয়নের সক্রিয় অংশীদার। এদের জীবনের গল্প ও সাফল্য তুলে ধরতেই শুরু হয়েছে “Poroshi Diaries”—একটি মাল্টিমিডিয়া উদ্যোগ, যেখানে এই নারী-অভিনেত্রীদের কণ্ঠস্বর তুলে ধরা হয়।
একইসঙ্গে iFarmer নারী কৃষকদের ডিজিটাল কৃষি ব্যবস্থার আওতায় এনে প্রশিক্ষণ, ইনপুট ও বাজারসুবিধা দিচ্ছে। এর ফলে নারীরা এখন ভোক্তা থেকে প্রযোজক, এবং প্রান্তিক থেকে বাজার-নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠছেন। এই দুই উদ্যোগের সম্মিলিত প্রভাব শুধু অর্থনৈতিক নয়—এটি একটি নীরব সামাজিক রূপান্তরের প্রতিচ্ছবি।
আরও উদাহরণ:
ডিজিটাল পল্লী কেন্দ্রের নারী উদ্যোক্তারা আজ সৌর বিদ্যুৎ চালিত চাল কল, মিনি মিল, এবং কৃষি ইনপুট দোকান পরিচালনা করছেন।
মুক্তি কক্সবাজার সংস্থা রোহিঙ্গা ও হোস্ট কমিউনিটির তরুণদেরকে ইনোভেশন হাবে প্রশিক্ষণ দিয়ে ক্ষুদ্র উদ্যোগ শুরু করতে সহায়তা করছে।
উপসংহার: পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পারলে পিছিয়ে পড়তে হবে
২০২৫ সালের ব্যবসার চিত্র বলছে—শুধু পুঁজি থাকলেই হবে না, জানতে হবে প্রযুক্তি, বুঝতে হবে গ্রাহক, শ্রদ্ধা করতে হবে পরিবেশকে এবং হিসাব রাখতে হবে এক টাকাও। বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা যদি এই চারটি কৌশল গ্রহণ করতে পারেন, তাহলে তারা শুধু দেশের নয়, আন্তর্জাতিক বাজারেও প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবেন।