![]()
নিজস্ব প্রতিবেদক, কক্সবাজার
বিদেশি অনুদান কমে যাওয়ায় খাদ্য, শিক্ষা ও চিকিৎসাসেবায় চরম সংকট; অপুষ্টি ও পাচারের ঝুঁকিও বাড়ছে।
বিশ্বের সবচেয়ে বড় রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এখন আরও ভয়াবহ মানবিক সংকটের মুখোমুখি। কক্সবাজারে অবস্থিত এই শিবিরে বসবাসরত প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক এখন বিদেশি সহায়তা হ্রাস পাওয়ার কারণে ন্যূনতম খাদ্য, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
দিনে মাত্র একবেলার খাবার
জাতিসংঘের বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP) ২০২৩ সালে খাদ্য সহায়তার পরিমাণ প্রায় ৩০ শতাংশ কমিয়ে দেয়। এখন প্রতিদিন একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য বরাদ্দ মাত্র ২৭ সেন্ট, যা দিয়ে এক বেলার খাবারও ঠিকমতো জোটে না।
রোহিঙ্গা নারী হাসিনা বেগম বলেন,
“
আমরা কাজ করতে পারি না, দেশে ফিরতেও পারি না। এখন খাবারও কমে গেছে। শিশুদের জন্য কিছুই নেই।”
স্বাস্থ্য ও শিক্ষার বেহাল অবস্থা
শরণার্থী শিবিরগুলোতে ইতিমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে অনেক শিক্ষা কেন্দ্র। শিশুদের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে, অনেকেই ঝুঁকছে শিশু শ্রম বা মানব পাচারের দিকে।
স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত ওষুধ, ডাক্তার কিংবা সেবাকেন্দ্র নেই। অপুষ্টি ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়ছে।
অপরাধ ও পাচার বাড়ছে
সহায়তা কমে যাওয়ার সরাসরি প্রভাব পড়েছে ক্যাম্পের নিরাপত্তা পরিস্থিতিতেও। চোরাচালান, পাচার, যৌন নিপীড়ন এবং সন্ত্রাসী গোষ্ঠীর সক্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন ক্যাম্পে কর্মরত এনজিওকর্মীরা।
বাংলাদেশ সরকারের অবস্থান
বাংলাদেশ সরকার স্পষ্টভাবে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের দীর্ঘমেয়াদি আশ্রয় বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভব নয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে।
রোহিঙ্গা তরুণ আবদুল করিম বলেন, “বিশ্ব এখন ইউক্রেন, গাজা বা সুদান নিয়ে ব্যস্ত। কিন্তু আমরা যেন ভুলে যাওয়া মানুষ। কেউ আমাদের কথা বলে না।”
গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসংক্ষেপ:
বাসিন্দা সংখ্যা: প্রায় ১০ লাখ
অধিকাংশই: ২০১৭ সালে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা
প্রতিদিনের খাদ্য সহায়তা: মাত্র ২৭ সেন্ট
প্রধান ঝুঁকি: অপুষ্টি, মানব পাচার, শিশু শ্রম, অপরাধ
আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর করণীয় কী?
২০১৭ সাল থেকে বাংলাদেশ প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা শরণার্থীকে মানবিক আশ্রয় দিয়ে আসছে। কক্সবাজারের ঘনবসতিপূর্ণ পাহাড়ি অঞ্চলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী ক্যাম্প পরিচালনার এই দুঃসাধ্য দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশ নিজেই কাঁধে নিয়েছে।
কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি সহায়তা হ্রাস পাওয়ার কারণে পরিস্থিতি ভয়াবহ মানবিক সংকটে রূপ নিয়েছে। রোহিঙ্গারা খাদ্য, চিকিৎসা ও শিক্ষাসেবা থেকে ক্রমশ বঞ্চিত হচ্ছেন, যা অপরাধ, পাচার ও উগ্রবাদ বৃদ্ধির আশঙ্কা বাড়াচ্ছে।
এই অবস্থায় শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন দায়িত্ব নেওয়ার সময়। জাতিসংঘ, OIC, OPEC, WFP, EU এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর জন্য এখন জরুরি কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করা অপরিহার্য।
জাতিসংঘ ও সহযোগী সংস্থাগুলোর দায়িত্ব
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (WFP)
বর্তমানে একজন রোহিঙ্গা শরণার্থীর জন্য দৈনিক রেশন মাত্র ২৭ সেন্টে নেমে এসেছে। এই সংকট নিরসনে:
জরুরি তহবিল গঠন করতে হবে অপুষ্টি আক্রান্ত শিশু ও নারীদের জন্য;
উন্নত দেশগুলোর কাছে ফান্ডিং রিকোয়েস্ট পুনরায় জারি করতে হবে;
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত খাদ্য ব্যবহারে কম খরচে সহায়তা নিশ্চিত করতে হবে।
UNHCR ও IOM
থার্ড কান্ট্রি রিসেটেলমেন্ট প্রোগ্রাম পুনরায় সক্রিয় করতে হবে (যেমন কানাডা, জার্মানি, অস্ট্রেলিয়া);
ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় মানবিক টাস্কফোর্স ও প্রশিক্ষিত কর্মী নিয়োগে সহায়তা করতে হবে।
UNDP, UNICEF, WHO
অস্থায়ী শিক্ষা, শিশু পুষ্টি ও মা-শিশু স্বাস্থ্যসেবার জন্য স্বতন্ত্র জরুরি প্রকল্প চালু করতে হবে;
মানসিক স্বাস্থ্য, টিকাদান, এবং সংক্রামক রোগ নিয়ন্ত্রণে মোবাইল হেলথ টিম মোতায়েন প্রয়োজন।
ইসলামিক সহযোগিতা সংস্থা (OIC) কী করতে পারে?
রোহিঙ্গা ইস্যুতে একটি স্থায়ী কূটনৈতিক টাস্কফোর্স গঠন;
সৌদি আরব, কাতার, তুরস্কসহ সদস্য রাষ্ট্রগুলোকে তহবিল সংগ্রহে ঐক্যবদ্ধ হওয়া;
মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে আইনি সহায়তা ও প্রভাব সৃষ্টি।
OPEC ও তেল রফতানিকারক দেশের করণীয়
‘হিউম্যানিটারিয়ান অয়েল ফান্ড’ গঠন করে তেল বিক্রির আয়ের একটি অংশ মানবিক কাজে বরাদ্দ;
ক্যাম্পে পরিচ্ছন্ন রান্না প্রযুক্তি, সৌরবিদ্যুৎ ও জ্বালানি সহায়তা প্রকল্পে বিনিয়োগ।
অন্যান্য বহুপাক্ষিক দাতা ও প্ল্যাটফর্মের করণীয়
বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (ADB)
কক্সবাজার ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে হোস্ট কমিউনিটির অবকাঠামো উন্নয়ন;
বাংলাদেশ সরকারকে সফট লোন ও অনুদানভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদি সহায়তা প্রদান।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, G7, G20
রোহিঙ্গা সংকটকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে পুনরায় অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান;
দাতা সংস্থা ও ফাউন্ডেশনগুলোর মধ্যে সমন্বিত তহবিল ও প্রযুক্তিগত সহায়তা।
বাংলাদেশ তার মানবিক দায়িত্ব পালন করেছে, করছে, এবং সহনশীলতা বজায় রেখেছে। কিন্তু এখন সময় এসেছে—আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সামনে এগিয়ে আসার।
যদি রোহিঙ্গা সংকটকে একটি যৌথ বৈশ্বিক দায় হিসেবে না দেখা হয়, তাহলে এর অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া কেবল বাংলাদেশের ভেতরেই সীমাবদ্ধ থাকবে না—এর অভিঘাত ছড়িয়ে পড়বে পুরো দক্ষিণ এশিয়া এবং আন্তর্জাতিক মানবিক শৃঙ্খলার ওপর।
রোহিঙ্গা সংকট: বাংলাদেশের কাঁধে বহুমুখী চাপ
বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবির কক্সবাজারে অবস্থিত। সেখানে আশ্রয় নেওয়া প্রায় এক মিলিয়ন রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে নিয়ে যে সংকট শুরু হয়েছিল ২০১৭ সালে, তা আজ একটি দীর্ঘস্থায়ী অর্থনৈতিক, সামাজিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জে পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি অনুদান হ্রাস পাওয়ায় সংকট আরও গভীরতর হয়েছে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, বাংলাদেশের জন্য রোহিঙ্গা সংকট এখন কেবল একটি মানবিক ইস্যু নয়—এটি অর্থনীতি, জাতীয় নিরাপত্তা এবং কূটনৈতিক ভারসাম্যের জন্য এক চরম বাস্তবতা।
অর্থনৈতিক চাপ
সরকারি ব্যয় বেড়ে যাওয়া:
রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্যসেবা, পানি ও স্যানিটেশনসহ মৌলিক সেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পরোক্ষ ব্যয় বহন করছে। আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়ায় এই ব্যয় এখন নিজস্ব বাজেট থেকেই বহন করতে হচ্ছে, যার ফলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, অবকাঠামোসহ অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ খাতে বাজেট সংকুচিত হচ্ছে।
স্থানীয় বাজারে প্রতিযোগিতা:
অনেক রোহিঙ্গা শ্রমিক অনানুষ্ঠানিকভাবে স্থানীয় শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে, যার ফলে দরিদ্র স্থানীয় জনগণের কর্মসংস্থান ও মজুরি কমে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রতিযোগিতা স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ ও বৈরিতা সৃষ্টি করছে।
আন্তর্জাতিক সহায়তার ওপর নির্ভরতা:
NGO ও মানবিক সংস্থাগুলোর তহবিল সংকোচনের ফলে তাদের কার্যক্রম হুমকির মুখে। দীর্ঘমেয়াদে এই নির্ভরতাই আমাদের উন্নয়ন সক্ষমতার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়াবে।
সামাজিক ও নিরাপত্তাগত চাপ
নিরাপত্তা পরিস্থিতির অবনতি:
রোহিঙ্গা ক্যাম্প এলাকায় মাদক পাচার, অস্ত্র চোরাচালান, সহিংসতা ও জঙ্গি তৎপরতার ঝুঁকি ক্রমেই বাড়ছে। এতে কক্সবাজার ও আশেপাশের জেলার আইনশৃঙ্খলা হুমকির মুখে পড়ছে।
সামাজিক বিরূপতা ও উত্তেজনা:
স্থানীয়দের মধ্যে অভিযোগ রয়েছে যে, রোহিঙ্গারা অনেকক্ষেত্রে বেশি সুবিধা পাচ্ছেন। এই ধারণা সামাজিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক গভীর অসন্তোষের জন্ম দিচ্ছে—যা ভবিষ্যতে উত্তেজনা বা সহিংসতায় রূপ নিতে পারে।
পরিবেশগত ক্ষতি:
রোহিঙ্গা বসতির জন্য পাহাড় কেটে গৃহ নির্মাণ, বন উজাড় ও প্লাস্টিক বর্জ্যে এলাকাটি পরিবেশগতভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। ভূমিধস, বন্যা এবং জীববৈচিত্র্য হ্রাস এখন বাস্তবতা।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ
মিয়ানমারের অনিচ্ছা, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের নিষ্ক্রিয়তা, এবং প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর দ্বৈত নীতি—সব মিলিয়ে রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসন প্রায় থমকে গেছে। বিষয়টি বাংলাদেশের জন্য শুধু বিব্রতকর নয়, বরং রাজনৈতিকভাবে চাপেরও কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটি দীর্ঘমেয়াদি সংকট তৈরি হলে তা দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলবে। সীমান্ত এলাকার জনগণের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অসন্তোষ ও ক্ষোভ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার ঝুঁকি বহন করছে।
রোহিঙ্গা সংকট এখন আর কেবল মানবিক বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশ রাষ্ট্রের অর্থনীতি, সমাজ, নিরাপত্তা এবং পররাষ্ট্রনীতির ওপর বহুমাত্রিক চাপ তৈরি করছে।
বিদেশি সহায়তা হ্রাসের এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে—
একটি শক্তিশালী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
ক্যাম্প ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা ও নিয়ন্ত্রণ
স্থানীয় জনগণের মধ্যে সহনশীলতা বজায় রাখা
এবং সর্বোপরি, রোহিঙ্গা ইস্যুকে একটি আন্তর্জাতিক দায়িত্ব হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
বাংলাদেশের ছয় স্তরের কৌশল: সংকট মোকাবেলার জাতীয় রূপরেখা
বাংলাদেশ সরকার এই সংকট মোকাবেলায় ছয়টি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়েছে:
১. কূটনৈতিক প্রচেষ্টা:
জাতিসংঘ, OIC, EU, G20-তে সক্রিয় ভূমিকা, উচ্চ পর্যায়ের টিম গঠন
২. জাতীয় নিরাপত্তা:
ক্যাম্প নিরাপত্তায় র্যাব-আনসার ইউনিট, সীমান্তে প্রযুক্তিনির্ভর নজরদারি
৩. মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা:
শিক্ষা কেন্দ্র, কারিগরি প্রশিক্ষণ, স্মার্ট ID কার্ডের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত চলাচল
৪. পরিকল্পিত পুনর্বাসন:
ভাসানচরের আদলে নতুন সুরক্ষিত পুনর্বাসন অঞ্চল উন্নয়ন
৫. রাজনৈতিক অবস্থান:
রোহিঙ্গা সংকটকে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশলের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত
৬. গণমাধ্যম ও গবেষণা:
তথ্যভিত্তিক সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন ও গবেষণা কেন্দ্র গঠন
বিশ্ব কি চুপচাপ থাকবে?
বাংলাদেশ মানবিকতার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কিন্তু আন্তর্জাতিক সহায়তা কমে যাওয়া এখন কেবল আর্থিক বিষয় নয়—এটি এক মানবিক ব্যর্থতা।
রোহিঙ্গা শিশুদের এখন আর এক বেলা খাবারও নেই। পড়াশোনার সুযোগ নেই। স্বাস্থ্যসেবা নেই। যদি বিশ্ব এখনও নির্বাক থাকে, তবে ইতিহাস ক্ষমা করবে না।
এই সংকট বাংলাদেশের একার দায় নয়—এটি একটি বৈশ্বিক নৈতিক ও রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতা।