![]()
ফরিদপুরের রাজনৈতিক মাঠে দীর্ঘদিন ধরে আধিপত্য বজায় রেখেছিল আওয়ামী লীগ। কিন্তু দলটির কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়ার পর বর্তমানের নির্বাচনী পরিবেশ পাল্টে গেছে নাটকীয়ভাবে। চারটি সংসদীয় আসনজুড়ে এখন নতুন সমীকরণ—যেখানে বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, বিভিন্ন ইসলামি দল, সিপিবি, এনসিপি ও স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জায়গা করে নিতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন।
আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতি শুধু রাজনৈতিক শক্তির পুনর্বিন্যাস ঘটায়নি, বরং বহু ভোটারের মনেই তৈরি করেছে নতুন প্রশ্ন—অপরিচিত সমীকরণের মাঝে কেমন হবে আগামী নির্বাচন? মাঠপর্যায়ে প্রতিদিনই বাড়ছে গণসংযোগ, উঠছে নতুন অভিযোগ–প্রত্যাশা। বিরোধী দলগুলোর তৎপরতা যেন নির্বাচনী রাজনীতিকে নতুন করে প্রাণবন্ত করে তুলছে।
ফরিদপুর-১: বিএনপির কোন্দল, সুযোগ দেখছে জামায়াত ও ইসলামি দলগুলো
বোয়ালমারী, আলফাডাঙ্গা ও মধুখালী নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-১ আসনটি বিএনপির জন্য বরাবরই কঠিন। ২০০৫ সালের উপনির্বাচন ছাড়া দলটি কখনো জিততে পারেনি। এবারও দলীয় কোন্দল চরমে উঠেছে।
মনোনয়নপ্রত্যাশী খন্দকার নাসিরুল ইসলাম, শামসুদ্দীন মিয়া ও মনিরুজ্জামান মৃধা— তিনজনের অনুসারীদের বিরোধ এখন প্রকাশ্য। ২৩ অক্টোবর কমিটি গঠন নিয়ে দ্বন্দ্ব, এরপর ৭ নভেম্বর সংঘর্ষ—সব মিলিয়ে বিএনপি এখানেও প্রার্থী চূড়ান্ত করতে পারছে না।
এ সুযোগে পা জমিয়ে চলেছেন জামায়াতের মনোনীত প্রার্থী মো. ইলিয়াস মোল্লা, যিনি তিন উপজেলা ঘুরে ঘুরে নিয়মিত সভা-সমাবেশ করছেন। পাশাপাশি মুফতি শারাফাত হোসাইন (খেলাফত মজলিস), ওয়ালিউর রহমান (ইসলামী আন্দোলন), মুফতি জাকির হোসাইন কাসেমী (জমিয়ত) এবং এনসিপির হাসিবুর রহমান—সবাইই সমান গতিতে মাঠে আছেন।
শহীদ বিএনপি নেতা আবু জাফরের ছেলে বিএনএম প্রধান শাহ মো. আবু জাফরও জানিয়েছেন—বিএনপি তাকে মনোনয়ন দিলে তিনি লড়তে প্রস্তুত।
এ আসনে বিরোধী পক্ষের বৈচিত্র্য যতই বাড়ছে, ভোটারদের সিদ্ধান্ত ততই জটিল হয়ে উঠছে।
ফরিদপুর-২: ওবায়দুর রহমান ও সাজেদা চৌধুরীর ঐতিহ্যের লড়াইয়ে নতুন অধ্যায়
ফরিদপুর-২ আসনটি রাজনৈতিক ইতিহাসে দুটি পরিবারকে কেন্দ্র করেই পরিচালিত হয়েছে—বিএনপির প্রয়াত মহাসচিব কে এম ওবায়দুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের প্রয়াত সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য সাজেদা চৌধুরী।
বাবার উত্তরাধিকার বয়ে নিয়ে এবার লড়াইয়ে নেমেছেন ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শামা ওবায়েদ—যিনি বিএনপির কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। তাঁর বিশ্বাস, মানুষ তাঁর বাবাকে শ্রদ্ধা করে; উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষাই হবে তাঁর প্রধান অঙ্গীকার।
বিপরীতে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে নিয়মিত প্রচার চালাচ্ছেন জামায়াতের সোহরাব হোসেন। ইসলামি অন্যান্য দল—যেমন খেলাফত মজলিসের শাহ আকরাম আলী—এখানেও সক্রিয়।
এনসিপির তৎপরতা তেমন দৃশ্যমান নয়।
যদিও আওয়ামী লীগ অনুপস্থিত, দুই রাজনৈতিক পরিবারের প্রভাব এখনও এ অঞ্চলে তীব্রভাবে টের পাওয়া যাচ্ছে।
ফরিদপুর-৩ (সদর): বিএনপির প্রার্থী নিয়ে বিরূপতা, স্বতন্ত্র এ কে আজাদের উত্থান
সদরের আসনটি অতীতে পুরোপুরি বিএনপির ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত ছিল। প্রয়াত নেতা চৌধুরী কামাল ইবনে ইউসুফ টানা পাঁচবার এই আসনটি ধরে রেখেছিলেন। এবার তার মেয়ে নায়াব ইউসুফ মনোনয়ন পেলেও দলের অনেক নেতা-কর্মী এতে অসন্তুষ্ট।
জেলা বিএনপির আহ্বায়ক সৈয়দ মোদাররেছ আলীর সমর্থকেরা প্রার্থী পরিবর্তনের দাবিতে সমাবেশও করেছেন। তাদের অভিযোগ—“উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নেতৃত্বে তৃণমূলের মূল্যায়ন হয় না।”
এদিকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে আলোচনায় এসেছেন সাবেক এমপি এ কে আজাদ। তিনি বলেছেন—ফরিদপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন হলে তিনি জয়ী হওয়ার ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী।
বেকারত্ব হ্রাস, আইনশৃঙ্খলা উন্নয়ন ও চাঁদাবাজি বন্ধ করার প্রতিশ্রুতিও দিয়েছেন তিনি।
এই আসনে জামায়াত, খেলাফত মজলিস, জমিয়ত, ইসলামী আন্দোলন, সিপিবি ও এনসিপি—সব দলের প্রার্থী সক্রিয়, যা নির্বাচনী হিসাব আরও জটিল করে তুলেছে।
ফরিদপুর-৪: বিএনপি-জামায়াত মুখোমুখি, মাঠে ইসলামি দল ও বাম প্রার্থীরাও
ভাঙ্গা, সদরপুর ও চরভদ্রাসন নিয়ে গঠিত ফরিদপুর-৪ আসনে বিএনপির প্রার্থী শহীদুল ইসলাম আত্মবিশ্বাসীভাবে প্রচার চালাচ্ছেন। অন্যদিকে জামায়াতের প্রার্থী সরোয়ার হোসেনও সমান তৎপর।
শহীদুল ইসলাম বলেছেন, তিন উপজেলায় বিএনপির অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব মিটিয়ে তিনি ঐক্য গড়ে তুলতে পেরেছেন।
জামায়াত নেতা সরোয়ারের দাবি—“মানুষ আমাকে গ্রহণ করেছে এবং পরিবর্তনের পক্ষে আছে।”
ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, সিপিবি—সবার প্রার্থীই মাঠে রয়েছেন, ফলে বহু-মুখী রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
মানবিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা
আওয়ামী লীগ নিষ্ক্রিয় হওয়ায় ফরিদপুরের রাজনীতি নতুন দিক পেতে শুরু করেছে। বহুদিন ধরে একটি প্রভাবশালী দলের আধিপত্যে থাকা ভোটারদের সামনে এবার বিস্তৃত বিকল্প।
মানুষের আশা—
-
সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ,
-
প্রভাবমুক্ত প্রচার,
-
ন্যূনতম সংঘাত,
-
এবং সবচেয়ে বড়—নিজেদের ভোটাধিকার সুরক্ষিত থাকবে।
বহু প্রার্থী, বহু দল—সবকিছু মিলিয়ে ফরিদপুরের চার আসন আগামী নির্বাচনের সবচেয়ে নজরকাড়া অঞ্চলে পরিণত হয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য