![]()
বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে দ্রুত উন্নয়ন প্রকল্প, সীমিত রাজস্ব আয়, বৈদেশিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীলতা এবং বাড়তে থাকা সুদ ব্যয়ের টানে ভারী হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে প্রথমবারের মতো দেশের মোট সরকারি ঋণ ২১ দশমিক ৪৪ ট্রিলিয়ন টাকা ছাড়িয়ে যাওয়ায় বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এটি কেবল অর্থনৈতিক চাপ নয়, বরং একটি মানবিক ঝুঁকিও তৈরি করতে পারে, যার প্রভাব সরাসরি পড়বে সাধারণ মানুষের জীবনে, সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর।
অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক—দুই দিক থেকেই বাড়ছে চাপ
প্রকাশিত ঋণ বুলেটিন বলছে:
-
বৈদেশিক ঋণ: ৯.৪৯ ট্রিলিয়ন টাকা
-
অভ্যন্তরীণ ঋণ: ১১.৯৫ ট্রিলিয়ন টাকা
২০২১ থেকে ২০২৪—এই তিন বছরে বৈদেশিক ঋণ দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। মহামারির পর বাজেট সহায়তা, রূপপুর পারমাণবিক প্রকল্প, দেশে অবকাঠামোতে ব্যাপক বিনিয়োগ—এসব উন্নয়নচাপের উৎসেই মূলত এই ঋণবৃদ্ধি।
যা বলছে বিশেষজ্ঞরা: ঝুঁকি ‘মধ্যম’ থেকে আরও উপরে যাওয়ার সম্ভাবনা
সিপিডির সম্মানিত ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান স্পষ্ট ভাষায় সতর্ক করে বলেছেন— “এটি বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগজনক। রাজস্ব সংগ্রহের ধীরগতি এবং উচ্চসুদের অভ্যন্তরীণ ঋণ ভবিষ্যৎ ঋণচাপে তীব্রতা আরও বাড়াবে।”
তিনি আরও বলেন—অনেক বিদেশি ঋণে অনুদান নেই, রয়েছে কঠোর শর্ত, কম সময়ের মধ্যে পরিশোধের বাধ্যবাধকতা। এর ফলে দেশের ঋণ পরিশোধ-রাজস্ব অনুপাত বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে।
আইএমএফও তাদের সর্বশেষ বিশ্লেষণে বাংলাদেশকে ‘মধ্যম ঝুঁকিতে’ শ্রেণিভুক্ত করেছে—যা আগে ‘নিম্ন ঝুঁকিতে’ ছিল। অর্থাৎ ঋণ টেকসই রাখার পথ এখন অনেক সংকীর্ণ।
মানুষের জীবনে এর প্রভাব: বাজেট সংকোচন থেকে সামাজিক সুরক্ষার ঘাটতি
অর্থনীতিবিদদের ধারণা, ঋণ ও সুদের চাপ বাড়তে থাকলে সরকারের বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে তিন দিক থেকে—
-
সরকারি ভর্তুকির পরিমাণ কমবে
-
সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি সংকুচিত হবে
-
সাধারণ মানুষের ওপর করের চাপ বাড়তে পারে
এর মানে হচ্ছে—
-
দরিদ্র ও নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে
-
খাদ্য মূল্যস্ফীতি ও চিকিৎসার ব্যয় মানুষের জীবনমান আরও কমিয়ে দেবে
-
কর্মসংস্থানের সুযোগ কমে যাওয়ার ঝুঁকি বাড়বে
ঋণ কেবল সংখ্যা নয়—এটি সরাসরি সামাজিক ন্যায্যতা, খাদ্য নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর প্রভাব ফেলে।
সুদ পরিশোধ—অর্থনীতির সবচেয়ে দ্রুত ফুলে ওঠা ব্যয়
গত বছরে শুধুমাত্র সুদ পরিশোধেই বাংলাদেশ সরকার খরচ করেছে ১ লক্ষ ৩২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা।
-
বৈদেশিক ঋণের সুদ বেড়েছে ২১%
-
অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ বেড়েছে ১৬%
সুদ পরিশোধের ব্যয় এখন দেশের বার্ষিক শিক্ষাবাজেটের থেকেও বেশি—যা মানবিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা।
সমন্বিত ঋণ ব্যবস্থাপনা অফিস (DMO): সংকট মোকাবিলায় নতুন পদক্ষেপ
আইএমএফ–বিশ্বব্যাংকের সুপারিশে বাংলাদেশ একটি সমন্বিত ঋণ ব্যবস্থাপনা অফিস (DMO) গঠন করতে যাচ্ছে।
এই দপ্তর—
-
দেশের সব ধরনের সরকারি ও গ্যারান্টিযুক্ত ঋণ পর্যবেক্ষণ করবে
-
বার্ষিক ঋণগ্রহণ নীতি নির্ধারণ করবে
-
ঋণ ঝুঁকি বিশ্লেষণ করবে
-
ডাটাবেস তৈরি করবে
-
ঋণ ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনবে
বিশেষজ্ঞরা বলছেন—এই দপ্তর কার্যকরভাবে চালু হলে ঋণ সংকট নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব, তবে এর জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা, আধুনিক আইটি অবকাঠামো এবং দক্ষ কর্মী প্রয়োজন।
ভবিষ্যৎ নীতি নির্দেশনা: রাজস্ব সংস্কারই হবে সবচেয়ে জরুরি পদক্ষেপ
অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলছেন—
-
রাজস্ব আহরণ দক্ষিণ এশিয়ার গড়ের অর্ধেক হওয়ায় ঋণ চাপ বাড়ছে
-
এনবিআরকে ডিজিটালাইজেশন, দক্ষতা বৃদ্ধি এবং প্রশাসনিক সংস্কার জরুরি
-
ভবিষ্যৎ ঋণ নেওয়ার আগে কঠোর মূল্যায়ন প্রয়োজন
-
উচ্চসুদের স্বল্পমেয়াদি ঋণ বন্ধ করতে হবে
তিনি আরও সতর্ক করেন—“নতুন ঋণ নিয়ে যদি পুরনো ঋণ শোধ করতে হয়, তবে দেশ ঋণচক্রে পড়ে যাবে।”
শেষ কথা: ঋণ সংকট শুধু অর্থনীতি নয়—এটি একটি মানবিক সংকটেরও বার্তা
বাংলাদেশ তার উন্নয়ন যাত্রার একটি গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে। ঋণের পরিমাণ কেবল সংখ্যা নয়—এটি দেশের মানুষের খাবার, চিকিৎসা, শিক্ষা, ভবিষ্যৎ কর্মসংস্থান, নিরাপত্তা—সবকিছুর সঙ্গে জড়িয়ে আছে।
এই সংকট কাটিয়ে ওঠার পথ আছে—
-
সুসংহত রাজস্ব নীতি
-
উন্নয়ন প্রকল্পে কঠোর যাচাই
-
স্বচ্ছ ঋণ ব্যবস্থাপনা
-
রপ্তানির বহুমুখীকরণ
সময়ের সঙ্গে এই পদক্ষেপ নেওয়া গেলে বাংলাদেশের উন্নয়নধারা ধরে রাখা সম্ভব হবে—অন্যথায় ঋণের চাপ মানুষের জীবনে বড় মানবিক সংকটে পরিণত হতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য