![]()
প্রশাসনের শীর্ষ পদগুলোতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের ফলে নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতির সুযোগ মারাত্মকভাবে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে—এমন অভিযোগ তুলেছেন সচিবালয়ের কর্মকর্তারা।
তাদের মতে, এই নিয়োগ প্রথা শুধু প্রশাসনে হতাশা তৈরি করছে না, বরং সুশাসন ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়াকেও প্রভাবিত করছে।
বর্তমানে বেসামরিক প্রশাসনের ৮০ জন সচিব ও সচিব মর্যাদার কর্মকর্তার মধ্যে অন্তত ২০ জন চুক্তিভিত্তিকভাবে কাজ করছেন। এদের মধ্যে ১০ জন সিনিয়র সচিব পদে আছেন।
অন্তর্বর্তী সরকারের গত ১৪ মাসে অন্তত ১২ জন সচিব ও সিনিয়র সচিবকে গুরুত্বপূর্ণ পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে—যা প্রশাসনের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
শীর্ষ পদে অবসরপ্রাপ্তদের আধিপত্য
মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব এম সিরাজ উদ্দিন মিয়া, জনপ্রশাসন সচিব মো. এহছানুল হক, স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গনি—সবাই বর্তমানে অবসরোত্তর চুক্তিতে কর্মরত।
তাদের অনেকেরই সরকারি চাকরি থেকে অবসরের পর কেটে গেছে ১০ থেকে ১৫ বছর।
একজন জ্যেষ্ঠ সচিবালয় কর্মকর্তা বলেন,
“চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ মানে তিন-চারজন যোগ্য কর্মকর্তার পদোন্নতির পথ বন্ধ হয়ে যাওয়া। এতে প্রশাসনের ভেতরে গভীর অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে।”
সরকারের ব্যাখ্যা: ‘অবশ্যক পরিস্থিতি’
উপদেষ্টা পরিষদের এক সদস্য বলেন, জুলাই আন্দোলনের পর অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের পুনর্বহাল করা ছাড়া সরকারের বিকল্প ছিল না।
তার ভাষায়—
“নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের সময় পর্যাপ্ত যোগ্য কর্মকর্তার অভাব ছিল। তাই শুরুতে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগই ছিল একমাত্র কার্যকর বিকল্প।”
তবে তিনিও স্বীকার করেন, এখন এই নিয়োগের সংখ্যা ধীরে ধীরে কমিয়ে আনতে হবে এবং নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্য থেকে পদোন্নতির সুযোগ দিতে হবে।
বিশ্লেষকদের মত
সাবেক সচিব ও প্রশাসন গবেষক এ কে এম আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন,
“কারিগরি পদ বা বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এড়িয়ে চলা উচিত। এটি যোগ্য কর্মকর্তাদের জন্য ভালো পদে যাওয়ার দরজা বন্ধ করে দেয়।”
সাবেক এনবিআর চেয়ারম্যান বদিউর রহমানের মতে,
“চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য তদবির করা কর্মকর্তারা কখনও ভালো প্রশাসক হতে পারেন না। এ প্রথা সিভিল সার্ভিসের প্রাকৃতিক অগ্রগতিকে ব্যাহত করছে।”
জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ফিরোজ মিয়া বলেন,
“আগের কোনো সরকার শীর্ষ চার–পাঁচটি পদ একসঙ্গে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়নি। এটি প্রশাসনের স্বাভাবিক কার্যক্রমে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে।”
ঘন ঘন বদলিও ক্ষোভ বাড়াচ্ছে
চুক্তিভিত্তিক নিয়োগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের মধ্যেও ঘন ঘন বদলির ঘটনা ঘটছে।
নৌপরিবহন সচিব মোহাম্মদ ইউসুফ, স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের সচিব এম এ আকমল হোসেন আজাদ, মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের—সকলেই এক বছরের মধ্যেই বদলি হয়েছেন।
এক অতিরিক্ত সচিব ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন,
“যারা ১০–১৫ বছর প্রশাসনের বাইরে ছিলেন, তারা আধুনিক প্রযুক্তি–নির্ভর প্রশাসনিক প্রক্রিয়া বুঝতে পারছেন না। এতে নীতিনির্ধারণ ব্যাহত হচ্ছে।”
উপসংহার
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রশাসনে দক্ষতা ও মনোবল ধরে রাখতে হলে অবিলম্বে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের প্রবণতা নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে এবং নিয়মিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি নিশ্চিত করতে হবে।
নইলে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন কাঠামো দীর্ঘমেয়াদে স্থবির হয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাঠকের মন্তব্য