আট বছর পর পূর্ণাঙ্গ কমিটি পেল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। তবে এ কমিটিকে ঘিরে সংগঠনটির ভেতরে ও বাইরে উঠেছে নানা প্রশ্ন। ৪২০ সদস্যের বিশাল ‘ঢাউস’ কমিটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে।
গতকাল বুধবার রাত সোয়া ১০টার দিকে ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় ফেসবুক পেজে কমিটির তালিকা প্রকাশ করা হয়। এতে কেন্দ্রীয় সভাপতি মো. রাকিবুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দিনের স্বাক্ষর রয়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে এত বড় কমিটি আগে কখনও হয়নি—বলছেন শিক্ষার্থীরা। কেউ কেউ একে “সাংগঠনিক ঐক্যের প্রতিফলন” বললেও অনেকেই এটিকে “গঠনতন্ত্রবিরোধী এবং অকার্যকর” হিসেবে দেখছেন।
৮১ সদস্যের স্থলে ৪২০ জন
ছাত্রদলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় শাখায় সদস্য থাকার কথা মাত্র ৮১ জনের। কিন্তু ঘোষিত কমিটিতে সেই সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেশি, অর্থাৎ ৪২০ জন।
এদের মধ্যে ৫৫ জন সহসভাপতি, ৯২ জন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, ৬৩ জন সহসাধারণ সম্পাদক, ৬৪ জন সহসাংগঠনিক সম্পাদক এবং ৬২ জন সদস্য।
অন্যদিকে, ছাত্রী সদস্যের সংখ্যা মাত্র ১১ জন, যেখানে ১০ শতাংশ কোটা অনুযায়ী থাকা উচিত ছিল কমপক্ষে ৪২ জন ছাত্রী।
গঠনতন্ত্র না মানার অভিযোগ
বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলছেন, এত বড় কমিটি করার ফলে সংগঠনের শৃঙ্খলা রক্ষা কঠিন হবে এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণে অচলাবস্থা তৈরি হতে পারে।
ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় একটি সূত্র জানায়, “গঠনতন্ত্রের সীমা অতিক্রম করে যেভাবে এই কমিটি দেওয়া হয়েছে, তা মূল দলের ভাবমূর্তিতেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে।”
সংগঠনের নেতাদের ব্যাখ্যা
শাখা সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান এ বিষয়ে বলেন,
“বহুদিন ধরে কমিটি না থাকায় অনেক কর্মীকে মূল্যায়নের সুযোগ হয়নি। আমাদের সংগঠন গত ১৫ বছর ধরে নির্যাতিত হয়েছে—নেতাদের কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাই এবার আমরা অধিকাংশকে অন্তর্ভুক্ত করেছি।”
ছাত্রী সদস্য কম থাকার বিষয়ে তিনি বলেন,
“নারীরা রাজনীতিতে আগ্রহী হচ্ছেন না, তবে যারা স্বেচ্ছায় এগিয়ে এসেছেন, আমরা তাঁদের সম্মানের সঙ্গে জায়গা দিয়েছি।”
অতীতের প্রেক্ষাপট
এর আগে ২০১৭ সালে সর্বশেষ পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছিল, যেখানে সদস্য ছিলেন ২৪৩ জন। ২০২৩ সালে সেই কমিটি বিলুপ্ত হয়।
গত বছরের ১১ আগস্ট পাঁচ সদস্যের আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয়, যা এখন পূর্ণাঙ্গ করা হলো।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো, নতুন কমিটিতে পদ পেয়েছেন চাকসুর এজিএস (যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক) পদে বিজয়ী ছাত্রনেতা আয়ুবুর রহমান। তিনি বলেন,
“চাকসু নির্বাচনের পর আমরা চেয়েছিলাম সকলে মিলেমিশে সংগঠনকে শক্তিশালী করতে। নতুন কমিটি নিয়ে শিক্ষার্থীদের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হয়েছে।”
শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া
বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ এই বিশাল কমিটিকে “অন্তর্ভুক্তির প্রতীক” হিসেবে দেখছেন, আবার অনেকেই বলছেন—“এভাবে বড় কমিটি দিলে সক্রিয় নেতৃত্ব হারিয়ে যায়, কার্যকর কাজ কমে যায়।”
একজন শিক্ষার্থী বলেন,
“কমিটি বড় হলে সবাই সন্তুষ্ট হয়, কিন্তু বাস্তবে কাজ করে কয়জন? আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ে কার্যকর ছাত্ররাজনীতি ফিরিয়ে আনাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।”
বিশ্লেষণ: গণতান্ত্রিক সংগঠনে ভারসাম্যের গুরুত্ব
ছাত্ররাজনীতি কেবল নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা নয়—এটি ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের অনুশীলন ক্ষেত্র। কিন্তু যখন গঠনতন্ত্র উপেক্ষা করা হয়, তখন সংগঠন তার ভারসাম্য হারায়।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রদলের এই বিশাল কমিটি তাই এখন একটি ‘পরীক্ষা ক্ষেত্র’—যেখানে দেখা যাবে, সংখ্যার চেয়ে যোগ্যতা ও দায়িত্ববোধ কতটা প্রাধান্য পায়।
পাঠকের মন্তব্য