বাংলাদেশে সাম্প্রতিক সময়ে চীনের বেসরকারি কোম্পানিগুলোর বিনিয়োগ বাড়ছে। মার্চে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের চীন সফরের পর এই প্রবণতা আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও শিল্পায়নের সুযোগ তৈরি হলেও, অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মধ্যে এ নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।
হংকংভিত্তিক হান্ডা ইন্ডাস্ট্রিজ এ বছর বাংলাদেশের টেক্সটাইল খাতে সবচেয়ে বড় চীনা বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। শুরুতে ১৫০ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের আশ্বাস দিলেও, পরে তা বাড়িয়ে ২৫০ মিলিয়ন ডলার করেছে প্রতিষ্ঠানটি। এ বিনিয়োগে দুইটি পোশাক প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান ও একটি নিট-ডাইং কারখানা স্থাপন করা হবে, যেখানে প্রায় ২৫ হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হবে।
আরেক কোম্পানি খিয়াশি চট্টগ্রামের মিরসারাইয়ের বেপজা ইকোনোমিক জোনে ৪০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছে। ইতিমধ্যে তারা বাংলাদেশে আন্ডারগার্মেন্টস ব্যবসা পরিচালনা করছে, যেখানে ৩ হাজার ৭০০ শ্রমিক কর্মরত আছেন। নতুন কারখানায় আরও বড় আকারে কর্মসংস্থান হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
অন্যদিকে চীনের খ্যাতনামা চায়না লেসো গ্রুপ ৩২.৭৭ মিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগ চুক্তি করেছে। তাদের বিনিয়োগ মূলত পিভিসি পাইপ, সোলার প্যানেল, কিচেন ইকুইপমেন্ট, ওয়াটার পিউরিফাইয়ারসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য উৎপাদনে। বেজা ইতোমধ্যে কোম্পানিটিকে ১২.৫ একর জমি লিজ দিয়েছে।
তবে এই বিনিয়োগ নিয়ে মতভেদ রয়েছে। বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন, নবায়নযোগ্য জ্বালানির মতো নতুন খাতে চীনের অংশগ্রহণ ইতিবাচক। এতে দেশে দক্ষ মানবসম্পদ ও কর্মসংস্থান তৈরি হবে।
কিন্তু অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, চীনের এই বিনিয়োগ কেবল ব্যবসায়িক নয়, ভূরাজনৈতিক স্বার্থও এর সঙ্গে জড়িত। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধের কারণে চীন বিকল্প বাজার খুঁজছে এবং বাংলাদেশও তার অংশ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক এম এম আকাশ মনে করেন, “এই বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মানের তুলনায় অপ্রতুল এবং দীর্ঘমেয়াদে কাঙ্ক্ষিত সুফল নাও আনতে পারে।”
অন্যদিকে সিপিডির ফেলো গবেষক মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, চীনের এ বিনিয়োগকে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দেখা উচিত। “বাংলাদেশ এখনো ইউরোপ, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার বাজারে ডিউটি-ফ্রি সুবিধা পাচ্ছে। চীন সেই সুযোগ কাজে লাগাতেই এখানে আসছে,” তিনি মন্তব্য করেন।
দেশীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, গার্মেন্টস খাত এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। এখানে চীনের বিনিয়োগ যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি প্রয়োজন হাইটেক খাতে বিনিয়োগ। “চীন ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ায় সেমিকন্ডাক্টরসহ আধুনিক প্রযুক্তির কারখানা করছে, কিন্তু বাংলাদেশে শুধু গড়পড়তা পোশাক কারখানা বানাচ্ছে,” বলেন বিকেএমইএ নির্বাহী সভাপতি ফজলে শামীম এহসান।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের মতে, চীনা বিনিয়োগ কর্মসংস্থান তৈরি করলেও প্রযুক্তিগত দক্ষতা হস্তান্তরের ঘাটতি থাকছে। এ কারণে দীর্ঘমেয়াদে এর প্রভাব আশানুরূপ নাও হতে পারে। তবে সরকারের প্রত্যাশা, এই বিনিয়োগ বিদেশি বিনিয়োগে এক নতুন ধারা তৈরি করবে এবং ভবিষ্যতে অন্য দেশগুলোকেও উৎসাহিত করবে।
পাঠকের মন্তব্য