কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই (AI) আজকের বিশ্বের প্রযুক্তিগত বিপ্লবের অন্যতম চালিকাশক্তি। AI এখন শুধু মানুষের জীবনধারাকে নয়, বরং আমাদের অর্থনীতি, পরিবেশ এবং শক্তি ব্যবস্থাকেও রূপান্তর করছে। GPT, DALL•E, Copilot-এর মতো জেনারেটিভ AI মডেলগুলো ব্যক্তিগত থেকে প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে ব্যবহার হচ্ছে, আর এর পেছনে প্রধান চালিকা শক্তি হলো বিদ্যুৎ। একদিকে, এআই-এর বিস্তার বিদ্যুৎ চাহিদা বাড়াচ্ছে; অন্যদিকে, AI-ই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদন, বিতরণ ও ব্যবহারকে আরও কার্যকর, বুদ্ধিদীপ্ত ও টেকসই করে তুলছে। তাই “AI ও শক্তি” এখন আর আলাদা দুটি খাত নয় — বরং একটি অন্তর্নিহিত প্রযুক্তিগত সম্পর্কের নাম, যা ভবিষ্যতের উন্নয়নের কৌশলে অপরিহার্য।
এআই-এর বিদ্যুৎ নির্ভরতা AI মডেল প্রশিক্ষণ এবং অপারেশনাল প্রসেসগুলো উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কম্পিউটিংয়ের উপর নির্ভরশীল। একটি বৃহৎ ডেটা সেন্টার একাই প্রতিদিন প্রায় এক লক্ষ পরিবারের সমান বিদ্যুৎ ব্যবহার করতে পারে। ২০২৪ সালে বিশ্বজুড়ে ডেটা সেন্টারগুলো মোট ৪১৫ টেরাওয়াট-ঘণ্টা বিদ্যুৎ ব্যবহার করেছে — যা বৈশ্বিক চাহিদার ১.৫%। অনুমান করা হচ্ছে, ২০৩০ সালের মধ্যে এই চাহিদা দ্বিগুণ হয়ে যাবে, যা জাপানের বর্তমান বিদ্যুৎ ব্যবহারের সমান। এই বিশাল চাহিদা শুধু একটি সংখ্যা নয় — এটি বাস্তব জ্বালানি অবকাঠামো, গ্রিড স্থিতিশীলতা এবং বিদ্যুৎ নীতির উপর গভীর প্রভাব ফেলবে।
বিদ্যুৎ উৎপাদনের উৎস: নতুন ভারসাম্য AI-এর বিদ্যুৎ চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য শক্তি যেমন সৌর ও বায়ু বিদ্যুৎ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে এদের উৎপাদন ধারা সবসময় নিরবিচ্ছিন্ন নয়। ফলে প্রাকৃতিক গ্যাস, পারমাণবিক শক্তি (SMR), এবং উন্নত ভূ-তাপ শক্তিও ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ মিশ্রণে গুরুত্বপূর্ণ হবে। বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে নবায়নযোগ্য বিদ্যুৎ ক্রয়ের দিকে ঝুঁকছে, যা AI প্রযুক্তিকে আরও পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী করতে সহায়তা করছে।
এআই-এর শক্তি খাতে ব্যবহার AI বিদ্যুৎ ব্যবস্থাকে স্মার্ট করে তুলছে — ● গ্রিড পরিচালনা: AI ব্যবহার করে গ্রিডে লোড ব্যালান্সিং, পূর্বাভাস, বিভ্রাট শনাক্তকরণ এবং রক্ষণাবেক্ষণ সময়মতো করা সম্ভব হচ্ছে। ● তেল ও গ্যাস: AI দ্বারা ভূতাত্ত্বিক ডেটা বিশ্লেষণ, উৎপাদন অপ্টিমাইজেশন ও মিথেন নির্গমন হ্রাস সম্ভব হচ্ছে। ● শিল্প ও ভবন: AI ভবনের হিটিং-কুলিং নিয়ন্ত্রণ, শক্তি অপচয় রোধ এবং উৎপাদন স্বয়ংক্রিয়করণে ব্যবহৃত হচ্ছে।
প্রযুক্তি-শক্তি সংযোগের চ্যালেঞ্জ 1. ডিজিটাল স্কিল ঘাটতি: দক্ষ AI পেশাজীবীর অভাব অনেক ক্ষেত্রে বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। 2. বিদ্যুৎ গ্রিড দুর্বলতা: নতুন ডেটা সেন্টার স্থাপনে বিদ্যুৎ সংযোগ নিতে দেরি হচ্ছে এবং গ্রিড চাপ বাড়ছে। 3. সরবরাহ শৃঙ্খলের ঝুঁকি: AI হার্ডওয়্যারে ব্যবহৃত উপাদান যেমন গ্যালিয়াম প্রায় পুরোপুরি চীনের উপর নির্ভরশীল, যা ভূ-রাজনৈতিক ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
উন্নয়নশীল দেশের সুযোগ AI ও ডেটা সেন্টার খাতে বিনিয়োগের মাধ্যমে উন্নয়নশীল দেশগুলো তাদের অর্থনীতিকে প্রযুক্তিগতভাবে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে পারে। এই খাতে প্রবেশ তাদের “লেট টেকঅফ” থেকে সরাসরি “লিপফ্রগিং” এর সুযোগ তৈরি করে। ● নতুন কর্মসংস্থান: ডেটা লেবেলিং, সফটওয়্যার সেবা, গ্রাহক সহায়তা ইত্যাদিতে কাজের সুযোগ তৈরি হবে। ● বিদ্যুৎ অবকাঠামো উন্নয়ন: ডেটা সেন্টারই হতে পারে নির্দিষ্ট অঞ্চলে বিদ্যুৎ উন্নয়নের কেন্দ্রবিন্দু। ● নীতিমালা ও স্কিল ডেভেলপমেন্ট: উপযুক্ত নীতিমালা ও দক্ষ জনবল গড়ে তুললে এআই ও জ্বালানি খাতে আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ আসতে পারে।
বাংলাদেশের সম্ভাবনা বাংলাদেশে ইতোমধ্যে কিছু মূলধারার অগ্রগতি দেখা যাচ্ছে: ● ইন্টারনেট ব্যবহারে বিস্তার: ১৩ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী রয়েছে। ● ডেটা সেন্টার ও হাইটেক পার্ক: জাতীয় ডেটা সেন্টার, Hi-Tech City, এবং বিভিন্ন ক্লাউড অবকাঠামো গড়ে উঠছে। ● তরুণ কর্মশক্তি: বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম ফ্রিল্যান্সার দেশ। এই জনবলকে AI খাতে কাজে লাগানো যেতে পারে। চ্যালেঞ্জ: বিদ্যুৎ সরবরাহে স্থিতিশীলতা, নীতিগত স্পষ্টতা, এবং উচ্চশিক্ষায় AI শিক্ষার ঘাটতি। সম্ভাবনা: বাংলাদেশ চাইলে Inani, Kaliakoir বা Sylhet-এ AI ডেটা সেন্টার এবং সৌরবিদ্যুৎ একত্রে গড়ে তুলে নিজেকে “ডেটা সার্ভিস হাব” হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
উপসংহার AI এবং শক্তি খাতের সংযুক্তি ভবিষ্যতের প্রযুক্তিনির্ভর, টেকসই ও অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য। সুষ্ঠু পরিকল্পনা, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা এবং সময়োপযোগী নীতিমালার মাধ্যমে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলো বিশ্বে প্রযুক্তির নেতৃত্ব দান করতে সক্ষম হবে।
পাঠকের মন্তব্য