![]()
উত্তরাঞ্চলের মানুষের জীবনের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িয়ে আছে তিস্তা নদী। এই নদী তাদের কাছে শুধু পানি নয়; জীবিকা, কৃষি, নিরাপত্তা, আবেগ—সবকিছুর সম্মিলিত প্রতীক। বর্ষা এলে ভয়াবহ বন্যা আর শুকনো মৌসুমে খরার মতো তীব্র পানিশূন্যতা—এ দুই চরম বাস্তবতার মাঝেই যুগের পর যুগ জীবন কাটিয়ে আসছে তিস্তা–পাড়ের মানুষ। নাব্য সংকট, কৃষি জমিতে চর জেগে ওঠা, নদীভাঙন, ঘরবাড়ি হারানো আর বারবার বাস্তুচ্যুত হওয়ার যন্ত্রণা তাদের প্রতিদিনের সহচর।
এ অবস্থায় তিস্তা নিয়ে বড় কোনো রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ এখন স্থানীয় মানুষের কাছে টিকে থাকার প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। বহু প্রতিশ্রুতির পর আবারও আলোচনায় এসেছে বহুল প্রতীক্ষিত তিস্তা মহাপরিকল্পনা—যা স্থানীয়দের কাছে আশার আলো হলেও, রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের কাছে নতুন উদ্বেগের প্রশ্নও তুলে দেয়। প্রকল্পটি কি সত্যিই উত্তরাঞ্চলের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগ লাঘব করবে, নাকি নির্বাচনের আগে ভোটের সমীকরণ পাল্টানোর কৌশল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে—সেটি নিয়ে দ্বিধা স্পষ্ট।
দুই দেশের টানাপোড়েন: পানিবণ্টনই মূল সঙ্কট
তিস্তায় পানিবণ্টন নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের টানাপোড়েন দীর্ঘ চার দশকেরও বেশি সময় ধরে চলছে। ১৯৮৩ সালের অন্তর্বর্তী চুক্তি কিংবা ২০১১ সালে চূড়ান্ত হতে যাওয়া স্থায়ী চুক্তি—কোনোটিই আজো বাস্তবায়ন হয়নি। ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের আপত্তিতে চুক্তি বাতিল হওয়ার পর থেকে বিষয়টি আরও সংবেদনশীল হয়ে ওঠে। নদীর উজান ব্যবস্থাপনা নিয়ে ভারতের অবস্থান, আর ভাটির পানির সঙ্কটে বাংলাদেশের টিকে থাকার সংগ্রাম—এই দ্বন্দ্বই তিস্তাকে আজ রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক জটিলতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে এসেছে।
১২ হাজার কোটি টাকার তিস্তা প্রকল্প: আশার আলো নাকি বিভ্রান্তি?
প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার তিস্তা মহাপরিকল্পনায় আবারও তৎপরতা দেখা গেছে। চীনা দূতাবাসের প্রতিনিধিরা নদীর বিভিন্ন পয়েন্টে প্রাথমিক জরিপ সম্পন্ন করেছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথম ধাপে, যা ১০ বছর মেয়াদি, গুরুত্ব দেওয়া হবে নদীভাঙন রোধ, স্থায়ী বাঁধ নির্মাণ, সেচব্যবস্থার উন্নয়ন এবং তীর রক্ষা কাঠামো নির্মাণে।
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) ইতোমধ্যে প্রকল্পের খসড়া চীনা সরকারের কাছে পাঠিয়েছে। চীনের রাজনৈতিক বিভাগের পরিচালক জং জিং জানিয়েছেন—সবকিছু ঠিক থাকলে ২০২৬ সালের জানুয়ারিতে প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু হতে পারে। চীনা প্রতিনিধিরা বিএনপি, জামায়াত, এনসিপি এবং বিভিন্ন নদী–রক্ষা আন্দোলন সংগঠনের সঙ্গেও পৃথক বৈঠক করেছে, যা প্রকল্পটি এখন কেবল উন্নয়ন নয়, ভূ–রাজনীতির কেন্দ্রেও পরিণত হয়েছে বলে ইঙ্গিত দেয়।
স্থানীয় মানুষের অবর্ণনীয় দুর্ভোগের পরিসংখ্যান
রিভারাইন পিপলের গবেষণা বলছে—প্রতি বছর তিস্তার ভাঙন, প্লাবন ও কৃষি ক্ষতিতে পাঁচ জেলার মানুষের আর্থিক ক্ষতি দাঁড়ায় ১ লাখ কোটি টাকারও বেশি। বহু পরিবার প্রতি বছর বাস্তুচ্যুত হয়; অনেকে জীবনের শেষ সঞ্চয় হারিয়ে নি:স্ব হয়ে পড়ে। কারও ঘর ভেঙে যায়, কারও ফসল নষ্ট হয়, কারও জমি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যায়। তিস্তা–পাড়ের শিশু–কিশোররা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়, নারীরা নিরাপত্তাহীন জীবনে দিন কাটায়, আর পুরুষরা কর্মসংস্থানের অনিশ্চয়তায় ভেঙে পড়ে।
স্থানীয়দের অভিযোগ: প্রতিশ্রুতি অনেক, বাস্তবায়ন কম
স্থানীয় মানুষ মনে করেন—বছরের পর বছর বড় বড় প্রকল্পের ঘোষণা এলেও বাস্তবে তেমন উন্নয়ন হয়নি। তিস্তা যেন রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী প্রতিশ্রুতির হাতিয়ার হিসেবেই বেশি ব্যবহৃত হয়। নদী–খাতে বড় পরিবর্তন না হওয়ায় মানুষের আস্থা বারবার ভেঙে গেছে।
তাদের প্রশ্ন—এই প্রকল্প কি সত্যিই তাদের জীবনে স্থায়ী পরিবর্তন আনবে? নাকি নির্বাচনের আগে বারবারের মতো তিস্তাকে আবারও ভোট–রাজনীতির অংশ হিসেবে ব্যবহারের চেষ্টা?
আগের ইতিহাস: চীনের স্যাটেলাইট সিটির প্রস্তাব থেমেছিল কূটনীতিতে
সূত্র জানায়, আগের সরকারের সময় থেকেই চীনের সঙ্গে তিস্তা উন্নয়ন নিয়ে প্রাথমিক সমঝোতা হয়েছিল। ২০১৬ সালে চায়না পাওয়ার তিস্তার দুই পাড়ে আধুনিক স্যাটেলাইট শহর নির্মাণসহ বিশাল প্রকল্প প্রস্তাব করে। কিন্তু পানিবণ্টন নিয়ে ভারতের আপত্তি ও কূটনৈতিক জটিলতার কারণে প্রকল্পটি আর এগোয়নি।
স্থানীয়দের চাওয়া: রাজনীতি নয়, টিকে থাকার সমাধান
সব মিলিয়ে তিস্তা–পাড়ের মানুষের মুখে এখন একটাই প্রশ্ন––
তিস্তা মহাপরিকল্পনা কি সত্যিই তাদের বহু বছরের বেদনা, বাস্তুচ্যুতি ও ক্ষতির স্থায়ী সমাধান দিতে পারবে, নাকি এটি আবারো নির্বাচনী কৌশলের অংশ হয়ে থাকবে?
তাদের কাছে তিস্তা এখন নদী নয়—এটি টিকে থাকার স্বপ্ন, নিরাপত্তার শ্বাস, আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের বাঁচার পথ।