![]()
ভারতের আসাম সীমান্ত ঘেঁষা কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রাম কামাত আংগারিয়া—যা এখন সবার কাছে পরিচিত ভাসানীপাড়া নামে। ইতিহাসের কিংবদন্তি নেতা, অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির পথিকৃৎ এবং কৃষক-শ্রমিকের অকৃত্রিম বন্ধু মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর পদচারণায় এই গ্রামের বুকে আজও বয়ে চলে মানবতা, সংগ্রাম ও প্রগতির স্মৃতি।
সম্প্রতি গ্রামটিতে গিয়ে দেখা যায়, মাত্র চার কিলোমিটার দূরেই ভারতের আসাম সীমান্ত। প্রান্তিক মানুষের সংগ্রাম, নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, এবং আঞ্চলিক রাজনীতিকে কেন্দ্র করে ভাসানীর যে বিস্তৃত প্রভাব ছিল—তারই একটি জীবন্ত প্রমাণ এই গ্রাম।
১৯৪৮ সালে পথচলা শুরু: ভাসানীর ঘর ও দরবার হল
১৯৪৮ সালে মওলানা ভাসানী প্রথম আসে এখানে। তার সহচর মুসা ফকির–এর সহযোগিতায় গ্রামবাসীর কাছ থেকে ৩৫ বিঘা জমি কেনেন তিনি। এর মধ্যে প্রায় ১২ বিঘা জমিতে তিনি গড়ে তোলেন তার বসতভিটা ও দরবার হল। এই দরবার হলেই বসে তিনি ভক্ত, অনুসারী, নেতা-কর্মী, এবং আসাম—ত্রিপুরা—মেঘালয়সহ বিভিন্ন অঞ্চল থেকে আসা মানুষের সঙ্গে রাজনৈতিক আলোচনা ও কৌশল নির্ধারণ করতেন।
গ্রামটিতে তখন বিশুদ্ধ পানির চরম সংকট ছিল। মানুষের কষ্ট দেখে ভাসানী নিজেই ভক্তদের নিয়ে দরবার হলের পাশে একটি পুকুর খনন করেন—যা আজও সেই মানবিকতার ইতিহাস বহন করে।
পরিবারের বসবাস ও সংগ্রামের স্মৃতি
১৯৪৯ সালে ভাসানীর দ্বিতীয় স্ত্রী হামিদা খানম এবং তিন সন্তান—আবু বক্কর খান, আনোয়ারা খানম এবং মোনোয়ারা খানম—এই গ্রামে বসবাস শুরু করেন। এরপর থেকেই ভাসানীর পরিবারের সঙ্গে গ্রামবাসীর সম্পর্ক আরও গভীর হয়।
১৯৬৩ সালে হামিদা খানমের মৃত্যু হলে তাকে চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয় এখানেই।
ভাসানীর নাতি মনিরুজ্জামান খান ভাসানী (৪৮) এখনো বাড়িটিতে বসবাস করছেন। তিনি বলেন—
“দাদার প্রিয় এই বসতভিটা আমি কষ্টে আগলে রেখেছি। কিন্তু সামর্থ্যের অভাবে তার ব্যবহৃত খাট-চেয়ারসহ অনেক জিনিস সংরক্ষণ করতে পারছি না। প্রতিদিন মানুষ আসে, স্পর্শ করে, দেখে—কিন্তু সংরক্ষণের অভাবে এগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।”
ভূমিহীন মানুষের আশ্রয় ও মানবতার আলোকবর্তিকা ভাসানী
ব্রহ্মপুত্র নদের ভাঙনে ঘরবাড়ি হারিয়ে আসামের বহু পরিবার আশ্রয় নেয় এই গ্রামে। তাদের পাশে দাঁড়ান ভাসানী। ভূমিহীন, অসহায় মানুষের প্রতি তার মমত্ববোধ এবং নেতৃত্বের দৃঢ়তা তাকে স্থানীয়দের কাছে এক কিংবদন্তি মানবিক নেতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে।
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা মোহার আলী (৭৮) বলেন—
“ভাসানী সাহেব ছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন দূরদর্শী নেতা। তিনি এলেই হাজারো মানুষ ভিড় জমাতো। প্রতিটি কথা ছিল উপদেশের মতো।”
ভাসানীর সান্নিধ্য পাওয়া নিজাম উদ্দিন (৮০) স্মৃতিচারণ করে বলেন—
“তার সংস্পর্শে যে আসত, ভক্ত হয়ে যেত। এমন নেতৃত্ব আজকাল পাওয়া যায় না।”
অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে ইতিহাসের চিহ্ন
বাড়িটিতে রয়েছে ভাসানীর ব্যবহৃত খাট, চেয়ার, তৈজসপত্র ও অন্যান্য স্মৃতিচিহ্ন। কিন্তু সেগুলো আজ গুরুতর জরাজীর্ণ অবস্থায়। দীর্ঘদিনের অবহেলা, সংরক্ষণ পরিকল্পনার অভাব এবং সরকারি উদ্যোগ না থাকায় অমূল্য ঐতিহাসিক সম্পদগুলো ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামবাসী, দর্শনার্থী এবং ভক্তদের দাবি—
ভাসানীর নামে একটি আধুনিক কমপ্লেক্স, জাদুঘর ও পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা হোক, যাতে নতুন প্রজন্ম জানতে পারে তার জীবনদর্শন, সংগ্রাম, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং মানবিক নেতৃত্বগুণ।
ভাসানীপাড়া শুধু একটি গ্রাম নয়—এটি দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ইতিহাসের এক জীবন্ত দলিল। এই স্মারক সংরক্ষণ করা মানে শুধু ভাসানীকে নয়, মানবতা ও মানুষের অধিকারের সংগ্রামকে সম্মান জানানো।