দীর্ঘ চার দশক ধরে জলাবদ্ধতায় জর্জরিত যশোরের ভবদহ অঞ্চল অবশেষে নতুন আশার আলো দেখছে।
সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে ছয়টি নদীর ৮১ দশমিক ৫ কিলোমিটার পুনঃখনন প্রকল্পের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে জলাবদ্ধতা নিরসনের একটি নতুন অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে।
তবে, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান মনে করেন—এটি শুধু স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি সমাধান,
দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী সমাধানের জন্য আরও ভাবনা ও পরিকল্পনা দরকার।
নদী খনন প্রকল্পে সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব
শুক্রবার (২৪ অক্টোবর) যশোরের অভয়নগর উপজেলার ভবানীপুর গ্রামে আয়োজিত উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যোগ দিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন,
“সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে নদী খননের এই উদ্যোগে জলাবদ্ধতার অস্থায়ী সমাধান মিলবে,
তবে ভবদহের দীর্ঘমেয়াদি মুক্তির জন্য আমাদের আরও গভীরভাবে পরিকল্পনা করতে হবে।”
তিনি জানান, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও পানি উন্নয়ন বোর্ড একসঙ্গে কাজ করছে যাতে ভবদহ অঞ্চলের স্থায়ী জলাবদ্ধতা দূর করতে কার্যকর প্রকল্প নেওয়া যায়।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আমরা অন্তত আরও একটি প্রকল্প অনুমোদন করে যেতে পারব,
যা ভবদহের দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের পথ খুলে দেবে।”
প্রকল্পের পরিধি ও সময়সীমা
২৪ ইঞ্জিনিয়ার কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডের তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী এই নদী খনন কাজ পরিচালনা করবে।
আগামী ১১ নভেম্বর নদীতে ক্রস বাঁধ দিয়ে খনন কার্যক্রম শুরু হবে এবং আগামী বছরের ৩০ জুন এর মধ্যে কাজ শেষ করার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।
প্রকল্পের আওতায় পুনঃখনন করা হবে—
-
হরিহর নদী: ৩৫ কিলোমিটার
-
হরি–তেলিগাতি নদী: ২০ কিলোমিটার
-
আপারভদ্রা নদী: ১৮.৫ কিলোমিটার
-
টেকা নদী: ৭ কিলোমিটার
-
শ্রী নদী: ১ কিলোমিটার
মোট ব্যয়: প্রায় ১৪০ কোটি টাকা।
জনগণের আশা, ক্ষোভ ও বিতর্ক
অনুষ্ঠান চলাকালে স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দেয় সামান্য উত্তেজনা।
একদল জনগণ টিআরএম (Tidal River Management) বাস্তবায়নের দাবি তোলে,
অন্যদিকে মৎস্যঘের মালিকসহ অপর একটি অংশ এ পদ্ধতির বিরোধিতা করে স্লোগান দেয়।
প্রশাসনের হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি শান্ত হয়।
এ প্রসঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রকল্প পরিচালক লে. কর্নেল মামুন উর রশিদ বলেন,
“আমরা কাজে বিশ্বাসী। জনগণের আবেগ ও প্রত্যাশা আমরা বুঝি।
সবাই মিলে কাজ করলে ভবদহ আবারও প্রাণ ফিরে পাবে।”
ভবদহের মানুষ ও প্রকৃতির লড়াই
যশোরের অভয়নগর, কেশবপুর ও মনিরামপুর উপজেলার ১৬টি ইউনিয়নের
দুই শতাধিক গ্রাম চার দশক ধরে স্থায়ী জলাবদ্ধতায় ভুগছে।
কৃষিজমি অনাবাদি, ঘরবাড়ি পানিতে ডুবে থাকে মাসের পর মাস।
জীবিকা হারিয়ে অনেকে পেশা বদলাতে বাধ্য হয়েছেন।
ভবদহের নদীগুলো একসময় ছিল প্রাণবন্ত,
এখন সেখানে কচুরিপানা, পলি ও অব্যবস্থাপনার স্তূপ।
প্রকল্প শুরু হলেও স্থানীয়রা আশঙ্কা করছেন—
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া ভবদহ আবারও ডুবে যেতে পারে।
দীর্ঘমেয়াদি টেকসই সমাধান প্রয়োজন
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কেবল নদী খনন নয়,
নদীর প্রাকৃতিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার ও বৃষ্টির পানি ধারণ ব্যবস্থা নিশ্চিত করাই হবে স্থায়ী সমাধানের পথ।
অতিরিক্ত বাঁধ, ঘের সংস্কৃতি এবং অপরিকল্পিত বসতি ভবদহের প্রাকৃতিক জলপ্রবাহ ব্যাহত করেছে।
এই চক্র ভাঙতে হলে স্থানীয় জনগণ, প্রশাসন ও পরিবেশ বিশেষজ্ঞদের
একসঙ্গে কাজ করতে হবে—এমন মত দিয়েছেন রিজওয়ানা হাসানও।
শেষ কথা
ভবদহের জলাবদ্ধতা এখন শুধু একটি পরিবেশগত নয়, বরং একটি মানবিক সংকট।
সেনাবাহিনীর নদী খনন উদ্যোগে আশার আলো দেখা গেলেও,
দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া ভবদহের মানুষ বারবার একই দুঃস্বপ্নে ফিরে যাবে।
প্রকৃতি যদি মুক্ত হয়, তবেই ভবদহে ফিরবে কৃষি, জীবিকা ও হাসি।
পাঠকের মন্তব্য