বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের ইতিহাস প্রায় অর্ধশতাব্দীর। নানা সংকট ও প্রতিকূলতা পেরিয়ে আজ এ খাত দেশীয় অর্থনীতির প্রাণভোমরা।
রপ্তানি আয়ের ৮০ শতাংশের বেশি আসে এই খাত থেকে, যেখানে সরাসরি প্রায় ৪০ লাখ মানুষ কর্মরত এবং পরোক্ষভাবে জড়িত আরও দুই কোটিরও বেশি মানুষ।
অতীতের সেলাই মেশিন নির্ভর উৎপাদন এখন ধীরে ধীরে প্রবেশ করছে অটোমেশন ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে।
বিশ্বজুড়ে উৎপাদন পদ্ধতি বদলে যাচ্ছে। বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর প্রযুক্তি এখন গতি, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা বাড়াচ্ছে। বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে সেই যাত্রা।
অটোমেশন কেবল যন্ত্রের উন্নয়ন নয়, বরং এটি একটি নতুন কর্মসংস্থান কাঠামো তৈরি করছে—যেখানে দক্ষ মানবসম্পদই মূল চালিকাশক্তি।
অটোমেশন: ভয় নয়, সুযোগের নতুন দিগন্ত
অনেকে মনে করছেন অটোমেশন এলে কর্মসংস্থান কমে যাবে। কিন্তু বাস্তবে এর প্রভাব হবে সীমিত।
উৎপাদনের পরিবর্তে সবচেয়ে বড় রূপান্তর আসবে রপ্তানি প্রক্রিয়ায়—যেখানে গতি ও নির্ভুলতা বাড়বে বহুগুণ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) যুক্ত হলে নকশা, ডকুমেন্টেশন, প্যাকেজিং ও পরিবহনে সময় বাঁচবে।
এক ক্লিকেই দেখা যাবে কোন অর্ডার কোন ধাপে আছে—এতে পুরো উৎপাদন চেইন হবে স্বচ্ছ ও সহজতর।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ
বিজিএমইএর হিসাব অনুযায়ী, দেশে চার হাজারের বেশি পোশাক কারখানা রয়েছে।
এর মধ্যে বৃহৎ ও মধ্যম পর্যায়ের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ করার সক্ষমতা থাকলেও সবচেয়ে সংকটে রয়েছে এসএমই বা ছোট প্রতিষ্ঠানগুলো।
এসব প্রতিষ্ঠানই ছোট অর্ডারগুলো সম্পন্ন করে এবং কর্মসংস্থানে রাখে বড় অবদান।
তাদের জন্য বিশেষ সুদে ঋণ সুবিধা ও প্রযুক্তি সহায়তা এখন সময়ের দাবি।
না হলে অটোমেশনের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
শ্রমিক-নিয়োগকর্তার সম্পর্কে দরকার বিশ্বাস ও আইন মানা
শ্রমিক অসন্তোষের বিষয়টি এখনো পোশাক খাতের বড় চ্যালেঞ্জ।
শ্রম আইন মানার সংস্কৃতি এখনো পুরোপুরি গড়ে ওঠেনি—ফলে অনেক সময় খাতের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয়।
যেসব উদ্যোক্তা নিয়ম মেনে ব্যবসা করছেন, তাদের প্রতিষ্ঠানগুলো রাজনৈতিক পরিবর্তনের পরও স্থিতিশীল থেকেছে।
আইন মানা মানেই ব্যবসার টেকসই ভবিষ্যৎ—এই উপলব্ধিটিই এখন সবচেয়ে জরুরি।
বন্দর সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি
রপ্তানির গতি নির্ভর করে বন্দর ব্যবস্থার কার্যকারিতার ওপর।
চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতার ঘাটতি ও যানজটের কারণে অনেক সময় বিমানপথে পণ্য পাঠাতে হয়, যা ব্যয় বাড়ায়।
তাই ঢাকা–চট্টগ্রাম পর্যন্ত ডেডিকেটেড সড়ক ও রেল সংযোগ, পাশাপাশি নদীপথে পরিবহন বৃদ্ধি এখন অপরিহার্য।
বন্দর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো স্বচ্ছতা ও দ্রুততার সঙ্গে বাস্তবায়ন করলে রপ্তানি প্রবৃদ্ধি আরও ত্বরান্বিত হবে।
অর্থায়ন ও পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ
অর্থায়ন এখনো ব্যাংক নির্ভর। অথচ পুঁজিবাজারে পোশাক খাতের উপস্থিতি নগণ্য।
দেশে লিড সার্টিফাইড কারখানার সংখ্যা ২৬৮ হলেও, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত প্রতিষ্ঠান হাতে গোনা।
পুঁজিবাজারের প্রক্রিয়া সহজ ও দ্রুত করলে উদ্যোক্তারা আগ্রহী হবেন—ফলে স্বচ্ছতা ও দায়বদ্ধতাও বৃদ্ধি পাবে।
ন্যায্য মূল্য নির্ধারণের সময় এসেছে
বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে প্রয়োজন এসএমভি (স্ট্যান্ডার্ড মিনিট ভ্যালু) ভিত্তিক ফ্লোর প্রাইসিং।
এতে উৎপাদন ব্যয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে ন্যূনতম ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত হবে, শ্রমিকেরও জীবনমান উন্নত হবে।
এটি কেবল অর্থনৈতিক নয়, মানবিক ন্যায়েরও প্রতিফলন।
ভবিষ্যতের পথে বাংলাদেশ
অটোমেশন, শ্রম নীতি, বন্দর উন্নয়ন ও পুঁজিবাজারে অংশগ্রহণ—সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত নতুন দিগন্তে প্রবেশ করছে।
এটি শুধু অর্থনীতির নয়, দুই কোটিরও বেশি মানুষের জীবিকার গল্প।
সঠিক পরিকল্পনা, প্রযুক্তি ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি মিললে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্প একদিন ছুঁয়ে ফেলবে টেকসই উন্নয়নের আদর্শ।
পাঠকের মন্তব্য