প্রযুক্তি মানুষের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু সেই প্রযুক্তিই যখন অপরাধের হাতিয়ার হয়ে ওঠে, তখন তা হয়ে যায় এক নীরব বিপর্যয়। ইলন মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা ‘স্টারলিংক’ এখন ঠিক সেই রূপেই দেখা দিচ্ছে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়।
মিয়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া, লাওস, ফিলিপাইন ও পূর্ব তিমুরজুড়ে গড়ে উঠেছে ভয়ংকর এক নেটওয়ার্ক—যাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো বলছে ‘স্ক্যাম সিটি’। এখানে রোমান্স স্ক্যাম (ভুয়া প্রেমের সম্পর্ক গড়ে টাকা হাতানো), বিনিয়োগ প্রতারণা বা পিগ-বাচারিং, অবৈধ অনলাইন জুয়া, ক্রিপ্টো জালিয়াতি, মানব পাচার, মাদক পাচার, অপহরণ ও মুক্তিপণ আদায়—সবকিছুর কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট সংযোগ।
জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দপ্তর (ইউএনওডিসি)-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শুধু ২০২৩ সালেই দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এ স্ক্যাম নেটওয়ার্কগুলো হাতিয়েছে ১৮ থেকে ৩৭ বিলিয়ন ডলার। সংস্থাটি সম্প্রতি সতর্ক করেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার বাড়তি নজরদারির কারণে চক্রগুলো এখন নতুন দেশে ঘাঁটি গাড়ছে, বিশেষত পূর্ব তিমুর, লাওস ও কম্বোডিয়ায়।
স্টারলিংকের অপব্যবহার: প্রযুক্তি যখন প্রতারণার ঢাল
স্টারলিংক একটি স্যাটেলাইটভিত্তিক ইন্টারনেট সেবা। এটি পৃথিবীর প্রায় সব জায়গায় সমান গতিতে ইন্টারনেট দেয়—যেখানে কোনো টেলিকম কোম্পানি বা ফাইবার সংযোগ নেই, সেখানেও এটি সচল থাকে। আর এই সীমাহীন সংযোগই এখন প্রতারক চক্রগুলোর প্রধান ভরসা হয়ে উঠেছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, তিনটি কারণে স্টারলিংক এসব অপরাধীদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়েছে—
১️স্থানীয় নেটওয়ার্কের বাইরে কাজ করে, তাই সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করলেও স্ক্যাম সেন্টার সচল থাকে।
২️গোয়েন্দা নজরদারি এড়ানো যায়, কারণ স্যাটেলাইট ডেটা স্থানীয় ট্র্যাকিং সিস্টেমে ধরা পড়ে না।
৩️পোর্টেবল ও দ্রুত স্থাপনযোগ্য, বিদ্যুৎ পেলেই যে কোনো স্থানে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে নতুন নেটওয়ার্ক চালু করা যায়।
ফলে অভিযান চালিয়েও চক্রগুলো দ্রুত স্থানান্তর হয়ে আবার সক্রিয় হতে পারে।
ডিজিটাল দাসত্বের ভয়ংকর চিত্র
এই স্ক্যাম সিটি গুলোতে শুধু প্রতারণাই নয়, চলছে মানব পাচার ও জোরপূর্বক শ্রমের নৃশংস বাস্তবতা।
জাতিসংঘের ভাষায়, এটি এখন “ডিজিটাল দাসত্বের নতুন রূপ।”
চাকরির প্রলোভনে তরুণদের বিদেশে নিয়ে গিয়ে এসব কেন্দ্রে বন্দি রাখা হয়। তাদের পাসপোর্ট কেড়ে নেওয়া হয়, টার্গেট পূরণ না হলে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অনেকে রোমান্স স্ক্যামের আড়ালে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় করে।
সম্প্রতি থাই-মিয়ানমার সীমান্তের কেকে পার্ক এলাকায় সেনাবাহিনী অভিযান চালিয়ে ৩০ সেট স্টারলিংক রিসিভার জব্দ করেছে এবং দুই হাজারের বেশি ব্যক্তিকে গ্রেফতার করেছে। কেকে পার্ক দীর্ঘদিন ধরেই এশিয়ার সবচেয়ে কুখ্যাত প্রতারণা ও জুয়া সিন্ডিকেটের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত।
বাংলাদেশও ঝুঁকিতে?
বাংলাদেশ এখনো সরাসরি এই চক্রের শিকার না হলেও, সাইবার বিশেষজ্ঞরা বলছেন “ঝুঁকি খুবই বাস্তব”।
তারা মনে করছেন, যেহেতু বাংলাদেশও স্টারলিংকের কভারেজ অঞ্চলের অন্তর্ভুক্ত, তাই স্থানীয় প্রতারক চক্রগুলো ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে বড় ধরনের অনলাইন অপরাধে জড়াতে পারে।
সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ সুমন আহমেদ সাবির বলেন,
“স্টারলিংক বন্ধ করা সমাধান নয়, বরং এর অপব্যবহার শনাক্ত করতে হবে। সরকারকে বিষয়টি অগ্রাধিকার দিতে হবে এবং স্টারলিংকের সঙ্গে সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যাতে অপরাধীরা যেন এ সিস্টেম ব্যবহার না করতে পারে।”
এথিক্যাল হ্যাকার সংগঠন ‘সাইবার ৭১’-এর পরিচালক আব্দুল্লাহ আল জাবের বলেন,
“স্যাটেলাইটভিত্তিক সংযোগ নিলে প্রতারণা ট্রেস করা অনেক কঠিন হয়ে যায়। তাই বাংলাদেশে স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন খুব জরুরি। এতে মেটাডাটা ও অবস্থান বিশ্লেষণ করে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।”
বাংলাদেশে অনলাইন প্রতারণার নতুন মাত্রা
দেশে বর্তমানে অনলাইন প্রতারণার রূপ বহুমুখী হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে বেশি দেখা যায়—
-
মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা
-
ফিশিং লিংক ও ভুয়া কাস্টমার কেয়ার কল
-
সোশ্যাল মিডিয়া হ্যাকিং
-
লোন অ্যাপ প্রতারণা
-
গেমিং টপ-আপ বা বেটিং সাইট প্রতারণা
এসব অপরাধ এখন ছোট শহর ও গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ছে।
সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার (মিডিয়া) জসীম উদ্দিন খান বলেন,
“সাইবার স্পেস সীমান্তহীন, তাই ঝুঁকিও বৈশ্বিক। বাংলাদেশ পুলিশ সর্বদা সতর্ক আছে। নাগরিকদেরও সচেতন থাকতে হবে। সন্দেহভাজন লিংক, কল বা অফার এড়িয়ে চলাই সেরা প্রতিরোধ।”
বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ ও মানবিক আহ্বান
প্রযুক্তি অগ্রগতির সঙ্গে মানবিক নিরাপত্তাও সমান জরুরি—এটাই এখন সময়ের দাবি।
বিশেষজ্ঞদের মতে,
-
স্টারলিংকের মতো প্রযুক্তির ওপর আইনগত ও নৈতিক কাঠামো তৈরি করতে হবে।
-
আন্তর্জাতিক সহযোগিতা বাড়াতে হবে, যাতে সীমান্ত অতিক্রম করা অপরাধ প্রতিরোধ করা যায়।
-
এবং সবচেয়ে বড় বিষয়, মানুষের সচেতনতা— কারণ প্রতারণার শেষ প্রতিরক্ষা প্রাচীর হলো সতর্ক নাগরিক।
উপসংহার:
প্রযুক্তির আলো যত বাড়ছে, ততই তার ছায়াও ঘন হচ্ছে। স্টারলিংক আমাদের সংযুক্ত করেছে আকাশের সঙ্গে, কিন্তু এর অপব্যবহার মানুষকে বেঁধে ফেলছে অদৃশ্য শৃঙ্খলে।
এখনই যদি বিশ্ব, বিশেষত দক্ষিণ এশিয়া, এই চক্রগুলোর বিরুদ্ধে যৌথভাবে এগিয়ে না আসে—তবে একদিন হয়তো আমাদের অনলাইন পৃথিবীই হয়ে উঠবে এক বিশাল স্ক্যাম সিটি।
পাঠকের মন্তব্য