বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল এক মুহূর্তের সাক্ষী হলো মঙ্গলবার সকাল। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি) দেশের বর্তমান ও সাবেক ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছে।
তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ—রাষ্ট্র ক্ষমতার আড়ালে ‘টিএফআই-জেআইসি’ নামের একটি গোপন সেলে থেকে গুম, হত্যা ও নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে সংশ্লিষ্ট থাকা। ঘটনাগুলো সংঘটিত হয়েছিল আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনামলে।
আজ (২২ অক্টোবর) সকালে ট্রাইব্যুনালের এই রায় ঘোষণা করেন প্রধান প্রসিকিউটর মো. তাজুল ইসলাম। তিনি সাংবাদিকদের বলেন,
“আজ আদালত ১৫ জন সেনা কর্মকর্তাকে আদালতে হাজির করা হলে তাদের জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন।”
তিনি আরও বলেন,
“তারা কোথায় রাখা হবে—ক্যান্টনমেন্টের অস্থায়ী কারাগারে নাকি কেন্দ্রীয় কারাগারে, তা সম্পূর্ণ নির্ভর করছে কারা কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্তের ওপর। প্রয়োজনে তাদের চট্টগ্রাম কারাগারেও স্থানান্তর করা হতে পারে।”
অতীতের ছায়া ও বর্তমানের প্রশ্ন
অভিযোগে বলা হয়েছে, এই কর্মকর্তারা ‘টিএফআই-জেআইসি’ (Task Force for Interrogation–Joint Interrogation Cell) নামে পরিচিত একটি গোপন জিজ্ঞাসাবাদ ইউনিটে কর্মরত ছিলেন। সেখানে রাজনৈতিক ভিন্নমতাবলম্বী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও সাধারণ নাগরিকদের অবৈধভাবে আটক ও নির্যাতনের শিকার হতে হয়েছে।
মানবাধিকার সংস্থাগুলোর দাবি, এ ধরনের কর্মকাণ্ড ছিল “রাষ্ট্রীয়ভাবে পরিচালিত গুম ও নির্যাতনের” এক দুঃসহ অধ্যায়, যা দীর্ঘদিন ধরেই আন্তর্জাতিক মহলের নজরে ছিল।
দেশি-বিদেশি মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ট্রাইব্যুনালের এই সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহির এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করবে।
ভুক্তভোগী পরিবারের প্রতিক্রিয়া
যেসব পরিবার বছরের পর বছর ধরে প্রিয়জনের খোঁজে ঘুরে বেড়াচ্ছিল, আজকের এ রায় তাদের মনে নতুন আশার আলো জ্বেলে দিয়েছে। রাজধানীর এক মানবাধিকার সংগঠনের সভায় ভুক্তভোগীর এক বোন বলেন,
“আমরা কোনো প্রতিশোধ চাই না। আমরা শুধু জানতে চাই, আমাদের ভাইদের কী হয়েছিল, কেন তারা ফিরল না।”
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই বিচার শুধু অতীতের অন্যায় উন্মোচনের জন্য নয়—এটি ভবিষ্যতে এমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
রাষ্ট্রের ভূমিকা ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা
সরকারি সূত্র জানায়, কারাগারে পাঠানো কর্মকর্তাদের মধ্যে কেউ কেউ সক্রিয় দায়িত্বে ছিলেন, কেউ অবসরপ্রাপ্ত। এই মামলা দুটি রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের জটিল অধ্যায় উন্মোচনে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করা হচ্ছে।
একজন সাবেক প্রসিকিউটর বলেন,
“এই বিচার শুধু ১৫ জনের নয়—এটি পুরো ব্যবস্থার দায়বদ্ধতার প্রশ্ন। বিচার ব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থা পুনরুদ্ধারে এটি এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।”
মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্ব
বিশ্লেষকদের মতে, এই মামলার সামাজিক প্রভাব গভীর। দীর্ঘদিন ধরে নিখোঁজ থাকা মানুষের পরিবারের সদস্যরা মানসিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন। এখন বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু হওয়ায় তারা ন্যায়বিচারের সম্ভাবনা দেখছেন, যা মানবিক মর্যাদা ফিরিয়ে আনার পথে এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
সমাপ্তি
বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থার এই পদক্ষেপ কেবল রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক নয়, এটি মানবিক দায়িত্বেরও প্রতিফলন।
প্রতিটি নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচারের অধিকার নিশ্চিত করতে এই রায় এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক হিসেবে ইতিহাসে জায়গা করে নেবে—এমনটাই আশা মানবাধিকারকর্মীদের।
পাঠকের মন্তব্য