ইসরায়েলের কারাগারে আটক বাংলাদেশের বিশিষ্ট আলোকচিত্রী ও মানবাধিকারকর্মী শহিদুল আলমকে তুরস্কের সহায়তায় মুক্ত করার তৎপরতা চলছে। শুক্রবার (১০ অক্টোবর) সকালে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক সরকারি পোস্টে এ তথ্য জানানো হয়।
পোস্টে বলা হয়, তুরস্কের কর্তৃপক্ষ আশাবাদ ব্যক্ত করেছে—আজই শহিদুল আলমকে বিশেষ বিমানে আঙ্কারায় নিয়ে আসা সম্ভব হতে পারে। যদিও তুর্কি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এখনো শতভাগ নিশ্চয়তা দিতে পারেনি, তবে আলোচনায় ইতিবাচক অগ্রগতি হচ্ছে বলে জানানো হয়।
বাংলাদেশের আঙ্কারাস্থ রাষ্ট্রদূত আমানুল হক বৃহস্পতিবার রাতে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
আন্তর্জাতিক তৎপরতা ও কূটনৈতিক প্রচেষ্টা
পোস্টে উল্লেখ করা হয়, শহিদুল আলম ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতে অবৈধভাবে আটক হওয়ার পরই বাংলাদেশ সরকার জর্ডান, মিসর ও তুরস্কে অবস্থিত নিজ নিজ দূতাবাসগুলোকে জরুরি যোগাযোগের নির্দেশ দেয়।
তাদের বলা হয়, “যত দ্রুত সম্ভব মুক্তির উদ্যোগ নিতে হবে।”
তিন দেশের দূতাবাস এখন স্থানীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সংশ্লিষ্ট আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করছে।
বাংলাদেশ সরকারের এক কর্মকর্তা বলেন,
“এটি শুধু একজন নাগরিককে মুক্ত করার বিষয় নয়—এটি মানবাধিকার ও ন্যায়বিচারের প্রশ্ন।”
ফ্রিডম ফ্লোটিলা: মানবতার নৌযাত্রা
শহিদুল আলম ‘ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন’-এর সঙ্গে গাজামুখী নৌযাত্রায় অংশ নিয়েছিলেন। এই উদ্যোগের উদ্দেশ্য ছিল ফিলিস্তিনে চলমান ইসরায়েলি আগ্রাসন ও নৌ অবরোধের বিরুদ্ধে প্রতীকী প্রতিবাদ।
এ যাত্রায় “থাউজেন্ড ম্যাডলিনস টু গাজা” নামের মানবিক উদ্যোগের আটটি নৌযানসহ মোট নয়টি জাহাজ অংশ নেয়।
সেখানে ছিলেন বিভিন্ন দেশের সাংবাদিক, চিকিৎসক, রাজনীতিবিদ ও মানবাধিকারকর্মীরা—যাদের মধ্যে শহিদুল আলম ছিলেন অন্যতম প্রভাবশালী কণ্ঠ।
গত বুধবার ইসরায়েলি সেনারা এই নৌবহরে আক্রমণ চালিয়ে সব অধিকারকর্মী ও নাবিককে আটক করে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো এ ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানায় এবং শহিদুলসহ আটক সবার মুক্তি দাবি করে।
শহিদুল আলম: প্রতিরোধের প্রতীক
আলোকচিত্রের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায়বিচার ও মানবতার পক্ষে দৃঢ় অবস্থান নেওয়া শহিদুল আলম বহু বছর ধরে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত।
তিনি দৃক গ্যালারি ও পাঠশালা মিডিয়া ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা।
গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকারের বিষয়ে তিনি সব সময় সক্রিয় ছিলেন।
বিশ্বজুড়ে পরিচিত এই আলোকচিত্রী ২০১৮ সালে বাংলাদেশে আটক হয়েছিলেন মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলার কারণে, যা নিয়ে আন্তর্জাতিক মহলে ব্যাপক আলোড়ন তৈরি হয়েছিল।
আজ আবারও তিনি একই নীতির পক্ষে দাঁড়াতে গিয়ে বন্দি হয়েছেন—তবে এবার অন্য দেশে।
মানবিক সংকটের মুখে বিশ্ব প্রতিক্রিয়া
তুরস্ক, জর্ডান ও মিসরের কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানায়, শহিদুল আলমসহ আটক কর্মীদের মুক্তির বিষয়টি এখন আন্তর্জাতিক আলোচনার অন্যতম অগ্রাধিকার।
তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেন,
“আমরা মানবতার পক্ষে দাঁড়াই। গাজা অবরোধের প্রতিবাদ করা অপরাধ নয়।”
বাংলাদেশের মানবাধিকার কর্মী ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের মানুষজনও সামাজিক মাধ্যমে শহিদুল আলমের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন।
ঢাকায় দৃকের সামনে আজ বিকেলেই এক নীরব মানববন্ধন আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানা গেছে।
মানবতার আহ্বান
দুই দশক ধরে আলোকচিত্রের মাধ্যমে শহিদুল আলম বিশ্বকে দেখিয়েছেন কীভাবে একটি ক্যামেরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে পারে।
আজ, তিনি নিজেই অন্যায়ের শিকার।
তবে তাঁর মুক্তির প্রচেষ্টা শুধু একজন মানুষের জন্য নয়—এটি মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানবতার মর্যাদা এবং ন্যায়বিচারের জন্য এক বিশ্বজনীন আহ্বান।
যদি তুরস্কের মধ্যস্থতায় আজই তাঁর মুক্তি নিশ্চিত হয়,
তবে এটি হবে শুধু এক কূটনৈতিক সাফল্য নয়—একটি মানবিক বিজয়।
পাঠকের মন্তব্য