দুই বছরের রক্তক্ষয়ী সংঘাতের পর অবশেষে গাজায় শান্তির আলো জ্বলার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। ইসরায়েলি সরকার শুক্রবার সকালে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের সঙ্গে যুদ্ধবিরতি চুক্তি অনুমোদন করেছে। এর ফলে আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার কথা, আর পরবর্তী ৭২ ঘণ্টায় শুরু হবে বন্দি ও জিম্মিদের বিনিময়ের প্রক্রিয়া—যা দুই জনগোষ্ঠীর দীর্ঘদিনের শোক, ক্ষোভ ও যন্ত্রণার মধ্যে এক মানবিক আশার সেতুবন্ধন তৈরি করেছে।
যুদ্ধের অবসান—মানবতার জয়
ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু তাঁর এক্স (সাবেক টুইটার) অ্যাকাউন্টে জানান, “সরকার জীবিত ও মৃত সব জিম্মি মুক্তির কাঠামো অনুমোদন করেছে।”
এ বক্তব্যের পরপরই ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিদের মধ্যে আনন্দের বন্যা দেখা দেয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজার রাস্তায় মানুষ কেঁদে ফেলেছে স্বস্তির অশ্রু—দুই বছর ধরে ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে থাকা আশার আলো যেন আবার জেগে উঠেছে।
মধ্যস্থতাকারীদের প্রচেষ্টায় তৈরি এই চুক্তি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় কূটনৈতিক সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। দুই বছর ধরে চলা এই সংঘাতে ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও লাখো মানুষ। শহর থেকে গ্রাম—সব কিছুই পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তূপে।
মানবিক বিপর্যয়ের ভেতর থেকে উঠে আসা শান্তির ডাক
গাজার নির্বাসিত হামাসপ্রধান খলিল আল-হাইয়া জানান, যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য মধ্যস্থতাকারীর কাছ থেকে তিনি যুদ্ধের অবসানের নিশ্চয়তা পেয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “এই চুক্তি শুধু বন্দি বিনিময়ের নয়, এটি আমাদের জনগণের জন্য জীবন ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি।”
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে, জাতিসংঘ ও মানবিক সংস্থাগুলোর তত্ত্বাবধানে খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী বহনকারী ট্রাকগুলো আবার গাজায় প্রবেশ করতে পারবে। যুদ্ধের কারণে যাঁরা শরণার্থীশিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন—তাঁদের মধ্যে নতুন করে বেঁচে থাকার প্রত্যাশা তৈরি হয়েছে।
দুই পক্ষের প্রতিশ্রুতি ও প্রক্রিয়ার রূপরেখা
চুক্তি অনুযায়ী,
-
ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে।
-
প্রথম পর্যায়ে ২০ জন জীবিত ও ২৬ জন মৃত ইসরায়েলি জিম্মির বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
-
হামাস ইঙ্গিত দিয়েছে, জীবিতদের মুক্তির তুলনায় নিহতদের মরদেহ উদ্ধার করতে বেশি সময় লাগতে পারে।
-
বিনিময়ে ইসরায়েলি কারাগারে থাকা নির্দিষ্ট সংখ্যক ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হবে।
ইসরায়েল সরকারের মুখপাত্র জানিয়েছেন, মন্ত্রিসভার অনুমোদনের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে, আর তিন দিনের মধ্যেই বন্দি বিনিময় শুরু হবে।
যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা ও ট্রাম্পের প্রতিক্রিয়া
গত বুধবার মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর “২০ দফা শান্তি পরিকল্পনার” প্রথম ধাপ বাস্তবায়নের ঘোষণা দেন। তিনি বলেন, “আমি অত্যন্ত গর্বিত যে ইসরায়েল ও হামাস উভয়েই আমাদের শান্তি পরিকল্পনার প্রথম ধাপে সই করেছে।”
বিশ্বনেতারা ইতোমধ্যে এই উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও আরব লীগ একে “মধ্যপ্রাচ্যে দীর্ঘমেয়াদী স্থিতিশীলতার সূচনা” হিসেবে বর্ণনা করেছে।
যুদ্ধের দগদগে ক্ষত, আর আশার শ্বাস
দুই বছরের বোমাবর্ষণ ও অবরোধে গাজার প্রায় ২০ লাখ মানুষ খাদ্য, চিকিৎসা ও আশ্রয়ের সংকটে দিন কাটিয়েছে। শিশুরা স্কুল হারিয়েছে, মা-বাবারা সন্তান হারিয়েছেন, এবং সম্পূর্ণ প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে ধ্বংসের ছায়ায়।
যুদ্ধবিরতির ঘোষণার পর গাজার খান ইউনিস এলাকার এক নারী, যার দুই সন্তান যুদ্ধের আগুনে প্রাণ হারিয়েছে, বলেন,
“আমরা আর কাঁদতে চাই না। শুধু শান্তিতে ঘুমাতে চাই, আর আমাদের বাচ্চাদের হাসতে দেখতে চাই।”
এই বক্তব্য যেন পুরো গাজার হৃদয়ের আর্তনাদ।
যুদ্ধের পর গাজার পুনর্গঠন—সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ
যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও গাজার সামনে এখন পুনর্গঠনের বিশাল চ্যালেঞ্জ। ধ্বংস হয়ে যাওয়া হাসপাতাল, স্কুল ও ঘরবাড়ি পুনরুদ্ধার করতে আন্তর্জাতিক সহায়তা অপরিহার্য হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এখনই প্রয়োজন এক দীর্ঘমেয়াদি মানবিক পুনর্গঠন পরিকল্পনা, যেখানে রাজনৈতিক হিসাবের ঊর্ধ্বে থাকবে মানবজীবনের মূল্য।
এক ফোঁটা আশার আলো
দুই বছরের রক্তপাত, অমানবিকতা আর ধ্বংসের পর আজ গাজা ও ইসরায়েল—উভয়ের জনগণ প্রথমবারের মতো এক বিন্দু আশার আলো দেখতে পাচ্ছে। যুদ্ধবিরতি চুক্তি শুধু রাজনৈতিক সমঝোতা নয়, এটি মানবতার আহ্বান, সহানুভূতির পুনর্জাগরণ।
যদি এই চুক্তি কার্যকর হয় এবং স্থায়িত্ব পায়, তবে মধ্যপ্রাচ্যের আকাশে আবার শান্তির সূর্য উঠবে—যা মানবসভ্যতার জন্য হবে এক ঐতিহাসিক বিজয়।
পাঠকের মন্তব্য