দুই বছরের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর গাজায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অংশ হিসেবে ২০০ জন মার্কিন সেনা মোতায়েনের পরিকল্পনা করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে কোনো মার্কিন সেনা গাজার মাটিতে অবস্থান করবে না বলে নিশ্চিত করেছে হোয়াইট হাউসের শীর্ষ কর্মকর্তারা।
বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) দুইজন সিনিয়র মার্কিন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে গণমাধ্যমকে জানান, এই সৈন্যরা একটি যৌথ টাস্ক ফোর্সের অংশ হবেন, যেখানে মিশর, কাতার, তুরস্ক এবং সম্ভাব্যভাবে সংযুক্ত আরব আমিরাতের সামরিক প্রতিনিধিরাও থাকবেন।
খবর প্রকাশ করেছে রয়টার্স।
বহুজাতিক টাস্ক ফোর্স: শান্তির নতুন কাঠামো
এই যৌথ টাস্ক ফোর্সের মূল লক্ষ্য—যুদ্ধবিরতি কার্যকর রাখা, নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণ এবং গাজায় মানবিক সহায়তার পথ সুগম করা।
একজন মার্কিন প্রতিরক্ষা কর্মকর্তা বলেন,
“আমরা কোনো যুদ্ধ মিশনে যাচ্ছি না। আমাদের ভূমিকা হবে নিরাপত্তা সমন্বয় ও পুনর্গঠনে সহায়তা করা।”
এই ফোর্স মূলত সামুদ্রিক ও আকাশপথে পরিচালিত হবে, যাতে গাজায় মানবিক ত্রাণবাহী কনভয় ও পুনর্গঠন কার্যক্রম নিরাপদভাবে চলতে পারে।
শারম আল-শেখে ঐতিহাসিক যুদ্ধবিরতি ঘোষণা
এর আগে বৃহস্পতিবার মিশরের উপকূলীয় শহর শারম আল-শেখে গাজায় দুই বছরের যুদ্ধের অবসান ঘটাতে একটি যুদ্ধবিরতি চুক্তি ঘোষণা করা হয়।
এই চুক্তির মধ্যস্থতা করেছে যুক্তরাষ্ট্র, মিশর, কাতার ও তুরস্ক।
চুক্তি অনুযায়ী—
-
ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে,
-
বন্দি বিনিময়ের প্রক্রিয়া শুরু হবে (ইসরায়েলের ২০ জন জীবিত জিম্মি ও ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দি মুক্তি পাবে),
-
এবং স্থায়ী যুদ্ধবিরতির রোডম্যাপ তৈরি হবে।
এই চুক্তি বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই যৌথ টাস্ক ফোর্স গঠনের সিদ্ধান্ত আসে।
ট্রাম্পের ২০ দফা গাজা পরিকল্পনা
গত ২৯ সেপ্টেম্বর প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গাজা ইস্যুতে একটি ২০ দফা শান্তি পরিকল্পনা প্রকাশ করেন।
এ পরিকল্পনায় ধাপে ধাপে শান্তি ও পুনর্গঠনের একটি বিস্তৃত কাঠামো দেওয়া হয়েছে। মূল দফাগুলো হলো:
-
সমস্ত ইসরায়েলি বন্দির মুক্তি বিনিময়ে প্রায় ২,০০০ ফিলিস্তিনি বন্দির মুক্তি।
-
স্থায়ী যুদ্ধবিরতি প্রতিষ্ঠা।
-
গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার।
-
হামাসকে বাদ দিয়ে নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠন।
-
ফিলিস্তিনি ও আরব-ইসলামী দেশগুলোর যৌথ নিরাপত্তা বাহিনী গঠন।
-
গাজা পুনর্গঠন তহবিল—আরব ও ইসলামী দেশগুলোর যৌথ অর্থায়নে।
-
সীমিত আকারে ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষের অংশগ্রহণ।
ট্রাম্প প্রশাসনের মতে, এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে মধ্যপ্রাচ্যের “সবচেয়ে জটিল সংঘাত” শান্তিপূর্ণ সমাধানের পথে যাবে।
নতুন প্রশাসনিক কাঠামো: হামাসবিহীন গাজা
পরিকল্পনার দ্বিতীয় ধাপে গাজায় নতুন প্রশাসনিক ব্যবস্থা গঠনের প্রস্তাব রয়েছে, যেখানে হামাসের কোনো সরাসরি ভূমিকা থাকবে না।
বরং গাজা পরিচালিত হবে ফিলিস্তিনি, আরব ও ইসলামী দেশগুলোর যৌথ প্রশাসনের মাধ্যমে, যা ধীরে ধীরে একটি স্থায়ী সিভিল গভর্নেন্সে রূপ নেবে।
বিশ্লেষকদের মতে, এটি গাজার রাজনীতিতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা হতে পারে, যদিও হামাস এখনো এই পরিকল্পনা বিষয়ে আনুষ্ঠানিক মন্তব্য করেনি।
গাজায় মানবিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ
দুই বছরের যুদ্ধ গাজাকে পরিণত করেছে মানবিক বিপর্যয়ের কেন্দ্রস্থলে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, ৬৭ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, এবং প্রায় ২০ লাখ মানুষ গৃহহীন।
এ অবস্থায় টাস্ক ফোর্সের প্রথম অগ্রাধিকার হবে—খাদ্য, পানি ও চিকিৎসাসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া, এবং অবকাঠামো পুনর্গঠন শুরু করা।
তবে মানবিক বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন—শুধু সামরিক তদারকি নয়, গাজায় দীর্ঘমেয়াদি পুনর্বাসন ও শিক্ষা-স্বাস্থ্য খাত পুনরুদ্ধারই হবে প্রকৃত পরীক্ষার জায়গা।
এক নতুন সূচনার সম্ভাবনা
মধ্যপ্রাচ্যে বহু বছর পর এমন একটি বহুপক্ষীয় শান্তি উদ্যোগ সামনে এসেছে যেখানে যুক্তরাষ্ট্র, তুরস্ক, মিশর, কাতার ও আমিরাত একসঙ্গে কাজ করছে।
যদি এই টাস্ক ফোর্স সফল হয়, তবে এটি শুধু গাজার নয়—পুরো অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য এক নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
এক কূটনীতিকের ভাষায়—
“যুদ্ধের শেষে যদি মানবিকতা ফিরে আসে, তবে এই ফোর্স শুধু সেনাবাহিনী নয়—এটি হবে শান্তির প্রতীক।”
পাঠকের মন্তব্য