ই-বাংলাদেশ ডেস্ক
যদি তুমি স্বাধীনতা চাও, যদি তুমি মুক্তি চাও; যদি তুমি এই ভূখণ্ডে নিজের সম্মান, মর্যাদা ও সততার সঙ্গে বাঁচতে চাও; যদি তুমি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি চাও, যদি তুমি প্রাচুর্য, সম্পদ ও সম্প্রীতি চাও; যদি তুমি শান্তি চাও, তাহলে অবশ্যই তোমাকে সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে
রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান, তুরস্কের প্রেসিডেন্ট
মধ্যপ্রাচ্য আজ এক অস্থিরতার কেন্দ্র। ইরানে ইসরায়েলি হামলা, গাজায় উত্তেজনা, সিরিয়ায় চলমান সংঘাত—এসবের মধ্যে তুরস্ক নিজেদের প্রতিরক্ষা শিল্পে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ নিয়েছে। ২৭ আগস্ট প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোয়ান আনুষ্ঠানিকভাবে দেশের সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেন ‘স্টিল ডোম’ আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
এটি শুধু একটি সামরিক উদ্যোগ নয়, বরং তুরস্কের স্বনির্ভর প্রতিরক্ষা শিল্প, প্রযুক্তি উদ্ভাবন এবং আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশের প্রতীক। প্রশ্ন হচ্ছে—এটি কি ইসরায়েলের বিখ্যাত ‘আয়রন ডোম’-এর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে পারবে?
আঞ্চলিক ভূরাজনীতি: কেন এখন স্টিল ডোম?
মধ্যপ্রাচ্যের ভূরাজনীতি দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে। ইরানের ওপর নজিরবিহীন হামলার পর তুরস্কে শঙ্কা ছড়িয়ে পড়েছে যে তারাও হতে পারে ইসরায়েলের পরবর্তী লক্ষ্য। এরদোয়ানের সরকার এই প্রেক্ষাপটে সামরিক সক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি প্রতিরক্ষা খাতে পূর্ণ স্বনির্ভরতা অর্জনের পরিকল্পনা নিয়েছে।
ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট পার্টির নেতা দেভলেত বাহচেলির ভাষায়—“ইরানের ওপর হামলা তুরস্ককে ঘিরে ফেলার ইসরায়েলের বৃহত্তর কৌশলের অংশ।”
অতএব, স্টিল ডোম শুধু একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়, বরং এটি তুরস্কের ভূরাজনৈতিক বার্তা—তারা আর কারো প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়, নিজেদের শক্তি দিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবিলা করতে প্রস্তুত।
স্টিল ডোম কী?
স্টিল ডোম একক কোনো প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নয়। বরং এটি “System of Systems”—তুরস্কের স্বল্প, মাঝারি ও দূরপাল্লার আকাশ প্রতিরক্ষা প্রযুক্তি, রাডার, সেন্সর, কমান্ড সেন্টার ও ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার ইউনিটের সমন্বিত প্ল্যাটফর্ম।
প্রথম ধাপে প্রতিরক্ষা কোম্পানি আসেলসান সামরিক বাহিনীর হাতে ৪৭টি যান সরবরাহ করেছে, যেখানে ছিল:
হিসার-এ প্লাস ও হিসার-ও প্লাস (স্বল্প ও মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা)
সিপের ব্লক-১ (দূরপাল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা)
আল্প ৩০০-জি ও ১০০-জি রাডার সিস্টেম
পুহু ও রেডেট ইলেকট্রনিক ওয়ারফেয়ার সিস্টেম
কোরকুৎ মোবাইল অ্যান্টি-এয়ারক্রাফট গান
এছাড়া আসেলসান ও রকেটসান উন্নয়ন করছে লেজারভিত্তিক গোকবার্ক ও আলকা সিস্টেম, যা ভবিষ্যতের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার দিক পরিবর্তন করতে পারে।
আয়রন ডোম বনাম স্টিল ডোম: মূল পার্থক্য
আয়রন ডোম (ইসরায়েল, ২০১১ থেকে চালু):
বিশেষায়িত স্বল্পপাল্লার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা
মূলত রকেট, মর্টার ও ড্রোন ধ্বংসে ব্যবহৃত
প্রায় ৯০% সফলতার দাবি
ব্যয়বহুল এবং যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে তৈরি
স্টিল ডোম (তুরস্ক, ২০২৫ থেকে চালু):
বহুমাত্রিক প্রতিরক্ষা সমন্বয়: স্বল্প, মাঝারি ও দূরপাল্লা
যুদ্ধবিমান, ক্রুজ মিসাইল, ড্রোন, ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র—সব ধরনের হুমকি মোকাবিলায় সক্ষম
নিজস্ব প্রযুক্তি ও শিল্পভিত্তিক উৎপাদন
এখনও বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত নয়
অতএব, আয়রন ডোম যেখানে নিশ্চিতভাবে প্রমাণিত ও বিশেষায়িত, স্টিল ডোম সেখানে বহুমুখী ও সমন্বিত, তবে বাস্তব যুদ্ধক্ষেত্রে কার্যকারিতা এখনও অজানা।
কেন উদ্যোক্তাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ?
প্রতিরক্ষা খাত সাধারণত রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে থাকে। তবে এর ভেতরে প্রযুক্তি উন্নয়ন, ইঞ্জিনিয়ারিং, আর্থিক মডেল, সাপ্লাই চেইন এবং রপ্তানি সম্ভাবনা—সবই উদ্যোক্তা মনস্কতার সঙ্গে সম্পর্কিত। স্টিল ডোম উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দেয়:
System Integration is the Future
নতুন কোনো প্রযুক্তি উদ্ভাবন না করেও বিদ্যমান সমাধানগুলোকে সমন্বিত করে নতুন বাজার সৃষ্টি করা যায়। যেমন, তুরস্ক তাদের বিভিন্ন প্রতিরক্ষা সিস্টেমকে একীভূত করেছে।
বাংলাদেশের স্টার্টআপগুলোর জন্য শিক্ষা: ফিনটেক, এগ্রিটেক বা হেলথটেকে বিচ্ছিন্ন সমাধানগুলো একত্রিত করে ইকোসিস্টেম তৈরি করা সম্ভব।
স্বনির্ভরতা বনাম আমদানি নির্ভরতা
প্রতিরক্ষা শিল্পে তুরস্ক বহু বছর আমদানি নির্ভর ছিল। এখন তারা নিজস্ব শিল্প গড়ে তুলছে।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য শিক্ষা: শুধু বিদেশি প্রযুক্তি ব্যবহার না করে দেশীয় উদ্ভাবন ও ট্যালেন্টে বিনিয়োগ করা জরুরি।
Global Branding & Export Potential
আয়রন ডোম ব্যয়বহুল ও রাজনৈতিকভাবে সংবেদনশীল। অনেক দেশ বিকল্প খুঁজছে। তুরস্কের স্টিল ডোম হতে পারে সেই সমাধান।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের শিক্ষা: স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের পথ তৈরি করতে হবে।
Innovation Through Collaboration
আসেলসান, রকেটসান ও TÜBİTAK মিলে সিপের ব্যবস্থা তৈরি করেছে। অর্থাৎ যৌথ উদ্যোগেই এসেছে এই সাফল্য।
বাংলাদেশে স্টার্টআপ, কর্পোরেট ও সরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান মিলে এ ধরনের সমন্বিত উদ্ভাবন সম্ভব।
আন্তর্জাতিক বাজার ও অর্থনৈতিক দিক
তুরস্কের প্রতিরক্ষা শিল্প এখন রপ্তানিমুখী। পাকিস্তান, কাতার, আজারবাইজান, আফ্রিকার বিভিন্ন দেশ ইতিমধ্যে তুর্কি ড্রোন কিনেছে। স্টিল ডোম কার্যকর প্রমাণিত হলে এটি মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার অনেক দেশের কাছে সাশ্রয়ী বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা হিসেবে বাজার পাবে।
এটি শুধু সামরিক কৌশল নয়, অর্থনৈতিক কৌশলও। প্রতিরক্ষা শিল্প এখন তুরস্কের রপ্তানি আয়ের অন্যতম উৎসে পরিণত হচ্ছে।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের জন্য বার্তা
বাংলাদেশ প্রতিরক্ষা শিল্পে সরাসরি প্রবেশ করতে পারবে না, কিন্তু প্রযুক্তি উদ্যোক্তাদের জন্য কিছু শিক্ষা রয়েছে:
ইকোসিস্টেম গঠন: বিচ্ছিন্ন সমাধান একত্রিত করলে শক্তিশালী প্রোডাক্ট তৈরি হয়।
স্বনির্ভরতা: শুধু বিদেশি সফটওয়্যার/হার্ডওয়্যার নয়, স্থানীয় প্রতিভা দিয়ে প্রযুক্তি তৈরি করা জরুরি।
রপ্তানি সম্ভাবনা: স্থানীয় সমস্যা সমাধানের পাশাপাশি বৈশ্বিক বাজারে প্রবেশযোগ্য সমাধান তৈরি করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি ভিশন: প্রতিরক্ষা শিল্পে যেমন ১০-১৫ বছরের রোডম্যাপ থাকে, উদ্যোক্তাদেরও একই রকম দীর্ঘমেয়াদি কৌশল গ্রহণ করা উচিত।
তুরস্কের স্টিল ডোম এখনও যুদ্ধক্ষেত্রে পরীক্ষিত নয়। তাই এটিকে আয়রন ডোমের সরাসরি প্রতিদ্বন্দ্বী বলা কঠিন। তবে এটি স্পষ্ট যে তুরস্ক নিজেদের প্রযুক্তি, শিল্প ও সামরিক সক্ষমতাকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাচ্ছে।
এই পদক্ষেপ শুধু সামরিক নিরাপত্তার বিষয় নয়—এটি উদ্ভাবন, স্বনির্ভরতা, রপ্তানি এবং প্রযুক্তি উদ্যোক্তা মনস্কতার একটি অনন্য উদাহরণ।
যেমন এরদোয়ান বলেছেন—
“যদি তুমি শান্তি চাও, তবে সব সময় যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।”
একইভাবে উদ্যোক্তাদের জন্যও বার্তাটি প্রযোজ্য— যদি প্রবৃদ্ধি চাও, তবে সব সময় উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে।