ভয়াবহ ভূমিকম্পে আবারও কেঁপে উঠল আফগানিস্তান। সোমবার ভোরে উত্তরাঞ্চলের মাজার-ই-শরিফের কাছে আঘাত হানা ৬ দশমিক ৩ মাত্রার ভূমিকম্পে এখন পর্যন্ত কমপক্ষে ২০ জন নিহত ও ৩২০ জনের বেশি আহত হয়েছেন। নিহতের সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
দেশটির স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র শরাফত জামান অমর জানিয়েছেন, আহতদের মধ্যে অনেকের অবস্থা আশঙ্কাজনক, এবং দুর্গম এলাকায় এখনো বহু মানুষ ধ্বংসস্তূপের নিচে আটকা রয়েছেন।
দুর্গম অঞ্চলে উদ্ধারকাজে বাধা
ভূমিকম্পটি ভোরে আঘাত হানায় অধিকাংশ মানুষ তখনো ঘুমে ছিলেন। ফলে ঘরবাড়ি ধসে বহু মানুষ হতাহত হয়েছেন। পাহাড়ি এলাকা ও দুর্গম গ্রামীণ সড়কগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উদ্ধার অভিযান চালাতে বেগ পেতে হচ্ছে স্থানীয় প্রশাসনকে।
তালেবান সরকারের মুখপাত্ররা জানিয়েছেন, উদ্ধারকর্মী ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিয়ে জরুরি কার্যক্রম শুরু হয়েছে, তবে দুর্গম পাহাড়ি পথের কারণে অনেক এলাকায় পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়েছে।
এক প্রত্যক্ষদর্শী বলেন,
“ভূমিকম্পের পরপরই ঘরগুলো দুলতে শুরু করে। মানুষ আতঙ্কে চিৎকার করে বাইরে দৌড়ে আসে। ধুলো আর কান্নার শব্দে গোটা গ্রাম কেঁপে উঠেছিল।”
ধ্বংসস্তূপে পরিণত গ্রাম, খোলা আকাশের নিচে রাত কাটাচ্ছে মানুষ
শোলগরা ও সমাঙ্গান প্রদেশের কয়েকটি গ্রাম প্রায় সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে। বালখ প্রদেশের তালেবান মুখপাত্র হাজি জায়েদ জানিয়েছেন,
“অধিকাংশ আহত ব্যক্তি উঁচু ভবন থেকে পড়ে আহত হয়েছেন। আমরা সব জেলায় ছোটখাটো আঘাত ও ধ্বংসের খবর পাচ্ছি।”
শোলগ্রা জেলার এক স্থানীয় সাংবাদিক জানিয়েছেন, বহু পরিবার এখন খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছে। আশপাশের হাসপাতালগুলোতে আহতদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে, তবে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
ভয় ও আতঙ্কে শহরজুড়ে দৌড়ঝাঁপ
ভূমিকম্পের সময় ৫ লাখের বেশি জনসংখ্যার মাজার-ই-শরিফে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। বহু মানুষ ভবন থেকে বেরিয়ে শহরের খোলা জায়গায় আশ্রয় নেন। অনেকেই জানান, ২০১৫ ও ২০২৩ সালের ভূমিকম্পের দুঃসহ স্মৃতি আবারও ফিরে এসেছে।
এক বাসিন্দা বিবিসিকে বলেন,
“আমরা এখনো ভয়ে আছি। ঘরে ঢোকার সাহস পাচ্ছি না। প্রতি মুহূর্তে আফটারশকের ভয়।”
ভূতাত্ত্বিক সতর্কতা ও ঝুঁকি
মার্কিন ভূতাত্ত্বিক জরিপ সংস্থা (USGS) জানিয়েছে, ভূমিকম্পটির কেন্দ্র ছিল মাজার-ই-শরিফ থেকে প্রায় ২৮ কিলোমিটার গভীরে। এটি সক্রিয় ফল্ট লাইনে অবস্থিত এলাকা, যেখানে নিয়মিত ভূমিকম্পের আশঙ্কা থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, আফগানিস্তান দুইটি বড় সক্রিয় ফল্টের ওপর অবস্থিত হওয়ায় দেশটি প্রতি বছরই ভয়াবহ ভূমিকম্পের ঝুঁকিতে থাকে।
পূর্ববর্তী ভয়াবহ স্মৃতি
এর আগে ২০২৩ সালে পশ্চিম আফগানিস্তানে একাধিক ভূমিকম্পে সহস্রাধিক মানুষ নিহত হয়েছিলেন। ২০১৫ সালের ভূমিকম্পে আফগানিস্তান ও পাকিস্তানে নিহত হয় শতাধিক মানুষ।
মানবিক সংস্থাগুলো বলছে, অবকাঠামোগত দুর্বলতা ও দরিদ্রতা দেশটিকে প্রাকৃতিক দুর্যোগে আরও ঝুঁকিপূর্ণ ও অসহায় করে তুলেছে।
সহায়তা কার্যক্রম শুরু
কাবুলের পুলিশ মুখপাত্র খালিদ জাদরান জানিয়েছেন,
“আমরা সতর্কভাবে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছি। উদ্ধার ও ত্রাণ কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে।”
জাতিসংঘের আফগানিস্তান মিশন (UNAMA) বলেছে, তারা ক্ষয়ক্ষতির তথ্য সংগ্রহ করছে এবং প্রয়োজনে জরুরি মানবিক সহায়তা দিতে প্রস্তুত।
উপসংহার
ধ্বংসস্তূপ, কান্না আর নিঃশব্দ আতঙ্কে কাঁপছে উত্তর আফগানিস্তান। বছরের শেষপ্রান্তে এসে আরেকটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় তাদের সামনে এনে দিয়েছে অসহায় বাস্তবতার মুখোমুখি।
উদ্ধারকর্মীদের সীমাহীন চেষ্টার মাঝেও প্রশ্ন রয়ে গেছে—
কবে শেষ হবে আফগান জনগণের এই ভূমিকম্পের বৃত্ত?
পাঠকের মন্তব্য