বাংলাদেশের একমাত্র প্রবালদ্বীপ সেন্ট মার্টিন—যেখানে প্রকৃতির প্রতিটি ঢেউ যেন প্রাণের ছোঁয়া নিয়ে আসে। বহু বছর ধরে পর্যটনের চাপ, প্লাস্টিক দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে হারাতে বসেছিল দ্বীপের অনন্য জীববৈচিত্র্য। তবে এবার আশার আলো দেখা যাচ্ছে। সম্প্রতি সেন্ট মার্টিনের ছেঁড়াদিয়ার সৈকতে ভেসে এসেছে এক বিরল প্রজাতির কাঁটাযুক্ত পটকা মাছ, যা দ্বীপের প্রাণপ্রবাহে নতুন আশার বার্তা এনেছে।
প্রবালদ্বীপে নতুন প্রাণের সাড়া
১৭ অক্টোবর সকালে জোয়ারের সময় ছেঁড়াদিয়ার পশ্চিম সৈকতে আটকে থাকা একটি অচেনা মাছ দেখতে পান পরিবেশ অধিদপ্তরের কর্মকর্তা মো. কামরুল হাসান। কাছে গিয়ে তিনি দেখেন, এটি এক কাঁটাযুক্ত সুন্দর পটকা মাছ—যা আগে কখনও এই এলাকায় দেখা যায়নি।
“এই প্রজাতির মাছের উপস্থিতি প্রমাণ করে দ্বীপের পরিবেশ আবার জেগে উঠছে,”
বললেন কামরুল হাসান, যিনি বর্তমানে সরকারের ‘সেন্ট মার্টিন দ্বীপের জীববৈচিত্র্য ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় অভিযোজন প্রকল্প’-এর প্রকল্প পরিচালক (পিডি)।
তিনি জানান, তিন বছর মেয়াদি এই প্রকল্পের আওতায় দ্বীপে চলছে কেয়াবাগান সৃজন, সচেতনতা বৃদ্ধি, সামুদ্রিক কাছিম সংরক্ষণ, জীববৈচিত্র্য পর্যবেক্ষণ ও প্রশিক্ষণমূলক কর্মসূচি।
এর ফলে দ্বীপে কাঁকড়া, কাছিম, শামুক-ঝিনুক ও পরিযায়ী পাখির সংখ্যা দৃশ্যত বেড়েছে।
বিরল প্রজাতির পটকা মাছ
গবেষকদের মতে, পাওয়া মাছটির বৈজ্ঞানিক নাম ডায়োডন হলোকানথাস (Diodon holocanthus)—যা long-spine porcupinefish নামেও পরিচিত। গায়ের রঙ হালকা বাদামি, শরীরজুড়ে ছোট ছোট কালো বিন্দু এবং কাঁটাযুক্ত খোলস এদের বৈশিষ্ট্য।
এই মাছ সাধারণত উষ্ণমণ্ডলীয় সমুদ্র ও প্রবালপ্রাচীরের কাছাকাছি এলাকায় বসবাস করে।
পটকা মাছের এক আশ্চর্য বৈশিষ্ট্য হলো, শত্রুর মুখে পড়লে এটি পানি বা বাতাস গিলে নিজেকে বেলুনের মতো ফুলিয়ে তোলে, যাতে কাঁটাগুলো বাইরের দিকে উঠে আসে এবং শিকারি প্রাণীরা আক্রমণ করতে ভয় পায়।
প্রকৃতি ফিরে পাচ্ছে ভারসাম্য
পরিবেশ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক জরিপে জানা যায়, সেন্ট মার্টিনে এখন প্রায় ১ হাজার ৭৬ প্রজাতির প্রাণীর উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে—যার মধ্যে রয়েছে প্রবাল, শৈবাল, কাছিম, পাখি, মাছ, স্তন্যপায়ী প্রাণী ও কাঁকড়া।
দ্বীপে পর্যটন সীমিত করা, প্লাস্টিক নিষিদ্ধকরণ ও নৌযান চলাচলে নিয়ন্ত্রণের ফলে দূষণ কমছে।
ইউপি সদস্য নাজির হোসেন বলেন,
“আগে এখানে শুধু সাদা রঙের পটকা দেখা যেত, কিন্তু এখন ছেঁড়াদিয়ায় কাঁটাযুক্ত সুন্দর পটকা মাছও দেখা যাচ্ছে। এটা ভালো লক্ষণ।”
দ্বীপের উত্তরপাড়ার মৎস্য ব্যবসায়ী জমির হোসেন জানান,
“আমাদের জালে মাঝে মাঝে তিন ধরনের পটকা পড়ে। এর মধ্যে কিছু বিষাক্ত, তাই কেউ খায় না। তবে এই নতুন প্রজাতির দেখা পাওয়া দ্বীপের জীববৈচিত্র্যের জন্য বড় খবর।”
জীবনের নতুন দিগন্ত
পরিবেশবিদেরা বলছেন, বিরল পটকা মাছের উপস্থিতি শুধু একটি প্রজাতির বেঁচে ওঠা নয়—এটি পুরো সেন্ট মার্টিনের পরিবেশের “স্বাস্থ্য ফেরা”-র প্রতীক।
দীর্ঘদিনের পরিবেশগত ক্ষত সারিয়ে, দ্বীপ এখন যেন আবার নিজের প্রাণ ফিরিয়ে নিচ্ছে।
প্রবালপ্রাচীরের ফাঁকে ফাঁকে ছোট মাছের নাচন, কাছিমের ডিম পাড়ার শব্দ, আর ঢেউয়ের সঙ্গে মিলেমিশে থাকা পটকা মাছের ছন্দ—সব মিলিয়ে যেন একটি পুনর্জাগরণের গল্প লিখছে বঙ্গোপসাগরের বুকের এই ছোট্ট দ্বীপটি।
পাঠকের মন্তব্য