বাংলাদেশের অর্থনীতি ও শাসনব্যবস্থার সংস্কার নিয়ে তীব্র হতাশা প্রকাশ করেছেন বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য। তিনি বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টার যে স্বপ্ন ও সংস্কারের আকাঙ্ক্ষা ছিল, তা তাঁর সহযোগী ও প্রশাসনিক কাঠামো যথাযথভাবে এগিয়ে নিতে পারেনি। এর ফলে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র প্রণয়ন, টাস্কফোর্স গঠনসহ নানা সংস্কারের উদ্যোগ আশানুরূপ গতি পায়নি।
গতকাল সিলেটে সিপিডির উদ্যোগে নাগরিক প্ল্যাটফর্মের প্রাক-নির্বাচনী আঞ্চলিক পরামর্শ সভা শেষে সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
“সংস্কারবিরোধী জোট এখনো অটুট”
ড. দেবপ্রিয় বলেন,
“সংস্কারবিরোধী এক জোট তৈরি হয়েছিল, যারা দেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থায় গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসেছে। এই জোট ভাঙতে হলে নির্বাচনী ইশতেহারে স্পষ্ট সংস্কার পরিকল্পনা থাকতে হবে। নতুন সরকার যদি সত্যিকারের পরিবর্তন চায়, তবে এই সংস্কারগুলো বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।”
তিনি মনে করেন, সংস্কার প্রণয়ন করা যত সহজ, বাস্তবায়ন করা তত কঠিন। তাই আগামী সরকারকে অবশ্যই এই রূপান্তরের পথে এগোতে হবে, কারণ বর্তমান সময়টি কেবল অন্তর্বর্তী নয়—এটি বাংলাদেশের জন্য একটি রূপান্তরকালীন সময়।
“দৃশ্যমান উন্নয়ন নয়, কাঠামোগত পরিবর্তন চাই”
সভায় মূল প্রবন্ধে উপস্থাপনাকালে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন,
“অতীতে আমরা দৃশ্যমান উন্নয়নে জোর দিয়েছি—বিল্ডিং, সেতু, অবকাঠামো—কিন্তু মানবসম্পদ উন্নয়নে তেমন গুরুত্ব দিইনি। স্কুল-কলেজের ইমারত হয়েছে, কিন্তু শিক্ষক-শিক্ষার্থীর মান উন্নয়নের উদ্যোগ হয়নি।”
তিনি আরও বলেন, দেশে একটি ‘চামচা পুঁজিবাদী অর্থনীতি’ তৈরি হয়েছে, যেখানে কিছু সুবিধাভোগী গোষ্ঠী রাষ্ট্রের কাঠামো ব্যবহার করে লুটপাটতন্ত্র ও চোরতন্ত্র গড়ে তুলেছে।
“এই চামচারা সংস্কারের পথে সবচেয়ে বড় বাধা। তারা উন্নয়নের নামে ধনী হয়েছে, কিন্তু দেশকে দুর্বল করেছে।”
“প্রধান উপদেষ্টার ইচ্ছা ভালো ছিল, কিন্তু সমর্থন পায়নি”
দেবপ্রিয়ের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার স্বপ্ন ছিল অর্থনীতিতে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সংস্কার প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু বাস্তবতার চাপে সেই স্বপ্ন পূর্ণতা পায়নি।
“প্রধান উপদেষ্টা যেভাবে অর্থনৈতিক শ্বেতপত্র ও সংস্কার রোডম্যাপ তৈরি করেছিলেন, তার বাস্তবায়নে প্রশাসনিক কাঠামো যথেষ্ট আগ্রহ দেখায়নি। ফলে সেই প্রক্রিয়া থেমে গেছে।”
তিনি বলেন, সরকারের উচিত এখন স্পষ্টভাবে জানানো—কতটা সংস্কার বাস্তবায়ন হয়েছে এবং কতটা বাকি। বাকি কাজগুলো নতুন সরকারের ইশতেহারে উল্লেখ করতে হবে, যাতে জনগণ জানে সামনে কী আসছে।
“নাগরিক মেনিফেস্টো আসছে”
অনুষ্ঠানে উপস্থিত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান বলেন,
“অতীতে রাজনৈতিক দলগুলো অনেক প্রতিশ্রুতি দিয়েছে, কিন্তু বাস্তবায়ন হয়নি। এবার আমরা নাগরিকদের মতামত নিয়ে একটি নাগরিক মেনিফেস্টো তৈরি করব—যেখানে মানুষের প্রত্যাশা, সংস্কার ও উন্নয়নের বাস্তব রূপরেখা থাকবে।”
তিনি আশা প্রকাশ করেন, বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ আর অতীতের পুনরাবৃত্তি হবে না।
“গত বছরের জুলাই আমাদের জন্য একটি বড় পরিবর্তনের সূচনা করেছে। এবার সময় এসেছে সেই পরিবর্তনকে টেকসই করার।”
মানবিক বাস্তবতা
সমগ্র আলোচনায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের উন্নয়ন এখন মানবিক ও প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কারের মোড় ঘুরানোর মুখে। কাঠামোগত দুর্বলতা দূর না করলে দৃশ্যমান উন্নয়ন টিকবে না।
দেবপ্রিয় ভট্টাচার্যের মতে,
“বাংলাদেশ এখন এমন এক সেতুবন্ধনের সময় পার করছে, যেখানে মানুষ, নীতি ও প্রতিষ্ঠান—তিনটিই একসাথে কাজ করতে হবে। না হলে স্বপ্ন অপূর্ণই থেকে যাবে।”
সংক্ষিপ্ত উপসংহার:
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নতুন দিশা আনতে হলে কাগজে নয়, বাস্তবে সংস্কার চাই। প্রধান উপদেষ্টার উদ্যোগকে এগিয়ে নিতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা, প্রশাসনিক দায়বদ্ধতা ও নাগরিক অংশগ্রহণ—এই তিনের সমন্বয়ই হতে পারে নতুন বাংলাদেশের ভিত্তি।
পাঠকের মন্তব্য