সংসদ সদস্যবিহীন বাংলাদেশেও চলতে থাকা ‘এমপি প্রকল্পে’ নতুন করে ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দিয়েছে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি)। প্রশ্ন উঠেছে—যে প্রকল্প মূলত সংসদ সদস্যদের নামে, তাঁদের উদ্যোগে স্থানীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়েছিল, এখন যখন সংসদই নেই, তখন কেন এই বাড়তি ব্যয়ের প্রয়োজন পড়ল?
পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারের সময় হাতে নেওয়া হয়েছিল ‘সর্বজনীন সামাজিক অবকাঠামো উন্নয়ন–২’ প্রকল্প, যা জনপ্রিয়ভাবে ‘এমপি প্রকল্প’ নামে পরিচিত। ২০২২ সালের জুলাই থেকে শুরু হওয়া এই প্রকল্পের প্রাথমিক ব্যয় ধরা হয়েছিল ১,০৮২ কোটি টাকা। অথচ সাম্প্রতিক প্রস্তাবে সেই ব্যয় ৪১৮ কোটি টাকা বাড়িয়ে ১,৫০০ কোটি টাকায় উন্নীত করার প্রস্তাব দিয়েছে এলজিইডি। অর্থাৎ ব্যয় বেড়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ।
এমপি ছাড়াই এমপি প্রকল্প
অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর এই প্রকল্পটি বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। নির্দেশ ছিল—যেসব খাতের কাজ প্রায় শেষ, সেগুলো দ্রুত শেষ করতে হবে; আর যেগুলোর দরপত্রই হয়নি, সেগুলো বাতিল করতে হবে। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে উল্টোটা—প্রকল্পের মেয়াদ ও ব্যয় দুটোই বাড়ানো হয়েছে।
প্রস্তাব অনুযায়ী, প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৬ থেকে বাড়িয়ে ২০২৭ সালের জুন পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছে।
পরিকল্পনা কমিশনের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, “সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম প্রকল্পটি আগের বরাদ্দের মধ্যেই শেষ হবে। এতে সর্বোচ্চ ৭০০ কোটি টাকা খরচ হতো। কিন্তু হঠাৎ নতুন করে ব্যয় বাড়ানো হচ্ছে—এটি অস্বাভাবিক।”
অগ্রগতি কম, ব্যয় বেশি
আইএমডির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রকল্পের শুরুতে বরাদ্দ ঠিক থাকলেও পরে বরাদ্দের ঘাটতি দেখা দেয়, ফলে অগ্রগতি ব্যাহত হয়েছে। এ পর্যন্ত মোট ব্যয়ের প্রায় ৬৪ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে, যেখানে ৭০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। কিন্তু আগামী দেড় বছরে আরও ৮০০ কোটি টাকা খরচের পরিকল্পনা করা হয়েছে।
অর্থাৎ প্রকল্পের অবশিষ্ট অংশে ব্যয় হচ্ছে আগের সমান কিংবা তারও বেশি।
প্রকল্পের সাবেক পরিচালক নাজমুল করিম এ বিষয়ে বলেন, “স্থানীয় জনগণের চাহিদা অনুযায়ী কাজ বাড়ানো হচ্ছে। সরকার উন্নয়ন চায় বলেই ব্যয় বৃদ্ধির প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে।”
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রকল্পের নামেই যখন সংসদ সদস্যদের ভূমিকা নিহিত, তখন সংসদ না থাকলে সেই প্রকল্পের যৌক্তিকতা নিয়েই প্রশ্ন উঠবে। একজন সাবেক কমিশন সদস্য বলেন, “এমপি প্রকল্পের আওতায় নতুন কোনো স্কিম অনুমোদনের প্রশ্নই ওঠে না। এর মাধ্যমে স্থানীয় উন্নয়নের নামে রাজনৈতিক সুবিধা নেওয়ার ঝুঁকিও থাকে।”
বৈষম্যমূলক বরাদ্দ
নতুন সংশোধনী প্রস্তাবে দেখা গেছে, চট্টগ্রাম জেলায় সর্বাধিক ৫১ কোটি ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দের প্রস্তাব রয়েছে, আর মেহেরপুরে সর্বনিম্ন ৫ কোটি টাকা। এই অস্বাভাবিক বৈষম্য নিয়েও প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের সবচেয়ে বড় উন্নয়ন বাজেট পরিচালনাকারী সংস্থা এলজিইডির উচিত হবে প্রকল্পগুলোর জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যাতে করদাতাদের অর্থের যথাযথ ব্যবহার হয়।
জনগণের প্রশ্ন: ‘এই টাকা কাদের জন্য?’
বাংলাদেশে উন্নয়ন এখন কেবল অবকাঠামো নির্মাণে সীমাবদ্ধ নয়; এটি মানুষের জীবনযাত্রার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত। তাই ‘এমপি প্রকল্পে’ এমপি না থাকলেও ব্যয় বাড়ানো জনগণের কাছে এক মানবিক ও নৈতিক প্রশ্ন ছুড়ে দিয়েছে—এই টাকা কাদের জন্য, কেন?
পাঠকের মন্তব্য