জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় আজ শুক্রবার ঐতিহাসিক ‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানের সকালেই দেখা গেল এক মানবিক ও প্রতীকী বিক্ষোভের চিত্র।
নিজেদের “জুলাই যোদ্ধা” পরিচয়ে শতাধিক মানুষ মঞ্চের সামনের আসনে বসে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন—তাদের দাবি, “আমাদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত পরিবর্তনের স্বীকৃতি এখনো আমরা পাইনি।”
‘আমাদের অন্তর্ভুক্ত না করে কীভাবে এই সনদ?’
সকালে মঞ্চের সামনে অবস্থান নিয়ে আন্দোলনকারীদের একজন ইমরান মিয়া বলেন,
“আমাদের আইনি ভিত্তি দিতে হবে। আমাদের অন্তর্ভুক্ত না করে কীভাবে এই সনদে স্বাক্ষর করবে তারা? আমাদের আগেও শান্তি ছিল না, এখনো নাই, ভবিষ্যতেও থাকবে না।”
ইমরান নিজেকে জুলাই যোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন। তার ভাষায়, “আমরা রাষ্ট্রের পরিবর্তনের জন্য রক্ত দিয়েছি, এখন সেই রাষ্ট্র যখন নতুন সনদ নিচ্ছে, সেখানে আমাদের জায়গা কোথায়?”
‘আমন্ত্রণও পেলাম না’—জুলাই শহীদ পরিবারের ক্ষোভ
শুক্রবার সকাল ১০টার পর থেকেই ‘জুলাই শহীদ পরিবার ও আহত যোদ্ধা’ ব্যানারে প্রায় শতাধিক মানুষ সংসদ ভবনের ১২ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেয়।
একপর্যায়ে তারা গেট টপকে ভেতরে প্রবেশ করে জুলাই সনদ স্বাক্ষর মঞ্চের সামনের চেয়ারে বসে পড়েন।
বিক্ষোভকারীদের হাতে ছিল ব্যানার ও প্ল্যাকার্ড—“রক্তের দামে পাওয়া পরিবর্তন, এখনো অস্বীকৃত”, “জুলাই সনদে যোদ্ধার নাম চাই”, “স্বীকৃতি নয়, ন্যায় চাই।”
ক্রাচে ভর দিয়ে আসা জিহাদ ইসলাম, যিনি নিজেকে আহত জুলাই যোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দেন, বলেন,
“আমাদের এত জোরাজুরি করে ঢুকতে হলো কেন? আমাদের কি ইনভাইট করা উচিত ছিল না? ১৫/২০ হাজার চেয়ার দিতে পারত না? আমাদের তো এই অনুষ্ঠানের প্রথম সারিতেই থাকার কথা ছিল।”
তার কণ্ঠে হতাশা ও বেদনার মিশ্র সুর—
“আমরা আন্দোলন করেছি, পা হারিয়েছি, চোখ হারিয়েছি। অথচ আজ যারা সেই আন্দোলনের সুফল ভোগ করছে, তারা আমাদের কথা ভুলে গেছে।”
‘এই সনদ মানি না’—ক্ষোভে মুখর আহত যোদ্ধারা
বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আরেকজন, জাকির হোসেন, বলেন,
“এই জুলাই সনদ মানি না। এই সনদে জুলাই যোদ্ধাদের মূল্যায়ন করা হয়নি। আমরা যারা আহত হয়েছি, তারা এখনো চিকিৎসা নিচ্ছি। অথচ আমাদের কোনো সরকারি সহায়তা বা পুনর্বাসন হয়নি। আমাদের দাবি অবিলম্বে জুলাই সনদ সংশোধন করতে হবে।”
তাঁদের মূল দাবি তিনটি—
১️ জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ পরিবারের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি ও তালিকাভুক্তি।
২️ আইনি সুরক্ষা ও পুনর্বাসন কার্যক্রম।
৩️ সনদে তাদের অবদানের আনুষ্ঠানিক উল্লেখ।
পুলিশের অবস্থান ও আলোচনা প্রক্রিয়া
বেলা ১১টার দিকে দেখা যায়, অনুষ্ঠানের মঞ্চ ও অতিথিদের আসনের মাঝখানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা বলয় তৈরি করে অবস্থান নিয়েছেন।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার ফজলুল করিম জানান,
“আমরা আন্দোলনকারীদের শান্তভাবে সরে যেতে বলেছি। কিন্তু তারা জানিয়েছেন, দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত তারা যাবেন না। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রতিনিধিরা আসছেন, তাঁদের সঙ্গে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হবে।”
এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার রাতেও সংসদ ভবনের বাইরে একই গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে বিক্ষোভ ও স্লোগান দেওয়া হয়।
মানবিক বাস্তবতা ও রাজনৈতিক প্রতীক
জুলাই সনদ, ২০২৫—এই দলিলকে বলা হচ্ছে রাষ্ট্র পুনর্গঠনের একটি ঐতিহাসিক নথি। কিন্তু এর প্রেক্ষাপটে যাদের আন্দোলন ও ত্যাগের ভিত্তিতে এই পরিবর্তন এসেছে, তারা যদি উপেক্ষিত হন, তাহলে সেটি এক মানবিক সংকটও বটে।
অনেকেই বলছেন, “সনদ শুধু রাজনৈতিক ঐক্যের প্রতীক নয়, এটি হওয়া উচিত জনগণের আত্মত্যাগের প্রতি কৃতজ্ঞতার প্রকাশ।”
আজকের এই বিক্ষোভ সেই মানবিক দায়বদ্ধতার প্রশ্নকেই সামনে নিয়ে এসেছে।
উপসংহার
জুলাই যোদ্ধারা বলছেন—“সনদে স্বাক্ষর নয়, চাই মর্যাদা।”
তাদের চোখে এই সনদ একদিকে প্রতিশ্রুতির, অন্যদিকে অবহেলার প্রতীক।
এখন দেখার বিষয়, সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশন তাদের দাবি কতটা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় নেয়।
পাঠকের মন্তব্য