“এটি শুধু কূটনৈতিক জয় নয়, বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক আত্মপরিচয়ের বিশ্বমঞ্চে উত্থান।”
বাংলাদেশের জন্য এটি এক ঐতিহাসিক মুহূর্ত। জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক সংস্থা— ইউনেস্কো–এর ৪৩তম সাধারণ পরিষদের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি ও ফ্রান্সে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত খন্দকার এম তালহা।
প্যারিসে মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর) অনুষ্ঠিত নির্বাহী পর্ষদের ২২২তম অধিবেশনে ভোটের মাধ্যমে এই মর্যাদাপূর্ণ পদে তাঁকে নির্বাচিত করা হয়।
রাষ্ট্রদূত তালহা এই প্রথম বাংলাদেশি, যিনি ইউনেস্কোর ৫৩ বছরের সদস্যপদ ইতিহাসে সংস্থাটির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পদে নির্বাচিত হলেন।
বাংলাদেশের জন্য গর্বের মুহূর্ত
প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস একে “ঐতিহাসিক অর্জন” হিসেবে আখ্যা দিয়ে বলেন—
“এটি বাংলাদেশের জন্য এক গর্বের মুহূর্ত। আমাদের শিক্ষা, সংস্কৃতি ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি বিশ্বের স্বীকৃতি এই নির্বাচন।”
শিক্ষা উপদেষ্টা ড. সি আর আবরার মন্তব্য করেন—
“ইউনেস্কোর সর্বোচ্চ পদে বাংলাদেশের নির্বাচন শিল্প, সংস্কৃতি ও শিক্ষায় আমাদের অবদানকে বিশ্বমঞ্চে নতুনভাবে উপস্থাপন করবে। এটি সত্যিই বিরল সম্মান।”
আর সাংস্কৃতিক উপদেষ্টা মোস্তফা সারওয়ার ফারুকী বলেন—
“ইউনেস্কোর সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সৃষ্টিশীলতা ও ঐতিহ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন মাত্রা পাবে। এটি আমাদের সাংস্কৃতিক কূটনীতির বিজয়।”
প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও নির্বাচনের প্রেক্ষাপট
এই নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাড়াও জাপান, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া প্রজাতন্ত্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। তবে গত সেপ্টেম্বরে ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়া তাদের প্রার্থিতা প্রত্যাহার করে নেয়, ফলে শেষপর্যন্ত জাপান ও বাংলাদেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা হয়।
নির্বাচনের ফল ঘোষণার পর ইউনেস্কোর অধিবেশনে উপস্থিত প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের নির্বাচনের প্রশংসা করে দাঁড়িয়ে করতালি দেন।
রাষ্ট্রদূত তালহার যাত্রা ও অবদান
খন্দকার এম তালহা—তিন দশকেরও বেশি অভিজ্ঞতার অধিকারী একজন পেশাদার কূটনীতিক।
১৯৯৫ সালে ফরেন সার্ভিসের ১৫তম ব্যাচে যোগদানের পর তিনি নিউইয়র্ক, তেহরান, জেনেভা ও লন্ডনে দায়িত্ব পালন করেছেন। সদর দপ্তরে ছিলেন রাষ্ট্রাচার প্রধান ও মহাপরিচালক (পূর্ব এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল)।
২০২১ সালে তাঁকে ফ্রান্স, মোনাকো, আইভরি কোস্ট ও ইউনেস্কোর স্থায়ী প্রতিনিধি হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
তাঁর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইউনেস্কোতে ধারাবাহিকভাবে ছয়টি গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনে জয়লাভ করেছে।
এর মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য সাফল্য হলো—
‘ঢাকার রিকশা ও রিকশা শিল্পকে’ বাংলাদেশের অপরিমেয় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতি আদায়।
রাষ্ট্রদূত তালহা শিক্ষা সংক্রান্ত টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (SDG-4) বাস্তবায়নের উচ্চপর্যায়ের কমিটির শেরপা হিসেবেও টানা দুই মেয়াদ দায়িত্ব পালন করেছেন।
তিনি স্বল্পোন্নত ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোর শিক্ষার জন্য বৈশ্বিক তহবিল গঠনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।
তাঁর বক্তব্যে কৃতজ্ঞতা ও অঙ্গীকার
নির্বাচনের পর রাষ্ট্রদূত তালহা বলেন—
“বাংলাদেশের প্রতি এই আস্থা বিশ্ব সম্প্রদায়ের আমাদের প্রতি বিশ্বাসের প্রতিফলন। আমি ইউনেস্কোর ম্যান্ডেট রক্ষায় নিরলসভাবে কাজ করব—বিশ্ব শান্তি, শিক্ষা ও সংস্কৃতির বিকাশে।”
তিনি আরও যোগ করেন—
“এটি শুধু আমার নয়, বাংলাদেশের জনগণের বিজয়। ইউনেস্কোর প্ল্যাটফর্মে আমরা মানবিক মূল্যবোধ, সৃজনশীলতা ও ঐতিহ্যের কণ্ঠস্বরকে আরও জোরালো করব।”
বাংলাদেশের কূটনীতিতে নতুন দিগন্ত
বাংলাদেশ এখন এক নতুন কূটনৈতিক অধ্যায়ের সূচনা করেছে।
এক সময় যেই দেশটি ছিল বৈশ্বিক সহায়তার গ্রহীতা, সেই দেশ আজ আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষ নেতৃত্বে—
এ যেন মানবিক, সাংস্কৃতিক ও নৈতিক নেতৃত্বের এক প্রতীকী উত্থান।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সাফল্য বাংলাদেশের জন্য বহুপাক্ষিক কূটনীতির একটি “গেমচেঞ্জার মুহূর্ত”।
ইউনেস্কোর এই মঞ্চ বাংলাদেশের শিক্ষা, ঐতিহ্য সংরক্ষণ ও সৃজনশীল অর্থনীতিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির পথ খুলে দিতে পারে।
উপসংহার
খন্দকার এম তালহার নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন ইউনেস্কোর সর্বোচ্চ পর্যায়ে।
এটি শুধুই পদ নয়—এটি এক সাংস্কৃতিক বিজয়, মানবিক মূল্যবোধের স্বীকৃতি এবং বাংলাদেশের বৈশ্বিক অবস্থানের নতুন সংজ্ঞা।
যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশ বিশ্বে মানবতার প্রতীক হিসেবে দাঁড়িয়েছিল,
তেমনি এই নির্বাচন আবারও জানিয়ে দিল—
বাংলাদেশ এখন নেতৃত্ব দেয়, অনুসরণ নয়।
পাঠকের মন্তব্য