জাহিদুজ্জামান সৈয়দ
ভৌগোলিক অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার নতুন রূপরেখা
সারসংক্ষেপ
পূর্ব ইউরোপে ইউরোপীয় ইউনিয়নের অগ্রগতি: ইউক্রেন ও মলদোভার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক, রাশিয়ার দুর্বল প্রভাব।
উত্তর আফ্রিকা ও তুরস্কে চীনের উত্থান: বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে অবকাঠামো ও বাণিজ্যে শক্ত অবস্থান।
চীনের কৌশল: দ্রুত অর্থায়ন, শর্তহীন ঋণ, অবকাঠামোতে দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগ।
ইইউ’র চ্যালেঞ্জ: মূল্যবোধ ও প্রতিযোগিতা—দুইয়ের ভারসাম্য রক্ষা।
বাংলাদেশের শিক্ষা: বৈচিত্র্যময় অংশীদারিত্ব, ভৌগোলিক অবস্থান কাজে লাগানো, টেকসই উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দেওয়া।
পরিবর্তিত ভূরাজনৈতিক অর্থনীতি
২১শ শতকের বিশ্ব অর্থনীতি গড়ে উঠছে ক্রমবদলশীল জোট, আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা এবং প্রভাব বিস্তারের হাতিয়ার হিসেবে অর্থনৈতিক কৌশল ব্যবহারের মাধ্যমে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ও চীন—এই দুই শক্তিই আজ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রতিদ্বন্দ্বী মডেল নিয়ে এগোচ্ছে।
নিউ জিওইকোনমিক ইন্টারকানেক্টিভিটি ইনডেক্স (GEOII)–এর তথ্য বলছে, ইইউ পূর্ব ইউরোপে তার প্রভাব শক্তিশালী করছে, কিন্তু উত্তর আফ্রিকা ও তুরস্কে দ্রুতই জায়গা হারাচ্ছে চীনের কাছে। এই বৈপরীত্য কেবল আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা নয়, বরং ভবিষ্যতের বৈশ্বিক বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও উন্নয়নকৌশলের বড় ইঙ্গিতবাহী।
পূর্ব ইউরোপে ইইউ’র কৌশলগত অগ্রগতি
ইউক্রেন ও মলদোভার ঝুঁকে পড়া ইউরোপমুখী
২০২২ সালের রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ পূর্ব ইউরোপের ভূরাজনীতি পুরোপুরি পাল্টে দিয়েছে। ইউক্রেন ২০২৩ সালে ইইউ প্রার্থী মর্যাদা পেয়েছে; মলদোভাও বাণিজ্য ও নীতি সহযোগিতা জোরদার করছে।
অর্থনৈতিক সহায়তা ও বিনিয়োগ
ইইউ কেবল প্রতিশ্রুতিই দেয়নি—বিলিয়ন ইউরো সহায়তা, অবকাঠামো পুনর্গঠন, পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল সংযোগে বিনিয়োগ করছে।
রাশিয়ার প্রভাবহীনতা
নিষেধাজ্ঞা, আন্তর্জাতিক বিচ্ছিন্নতা ও যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যস্ততার কারণে রাশিয়ার অর্থনৈতিক ভূমিকা সংকুচিত হয়েছে। শূন্যস্থান পূরণ করছে ইইউ, নিজেকে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলগত অংশীদার হিসেবে প্রতিষ্ঠা করছে।
উত্তর আফ্রিকা ও তুরস্কে ইউরোপের দুর্বলতা
উত্তর আফ্রিকায় চীনের দৃঢ় পদচারণা
বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (BRI) এর মাধ্যমে চীন মরক্কো, আলজেরিয়া ও মিশরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করেছে।
অবকাঠামোঃ সড়ক, বন্দর, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে চীনা কোম্পানি অগ্রণী।
বাণিজ্যঃ অনেক ক্ষেত্রে ইউরোপকে ছাড়িয়ে চীন শীর্ষ বাণিজ্য অংশীদার।
অর্থায়নঃ সহজলভ্য ঋণ, শর্তহীন চুক্তি—চীনের মূল আকর্ষণ।
অন্যদিকে ইইউ উন্নয়ন সহযোগিতায় শাসনব্যবস্থা, মানবাধিকার বা পরিবেশগত শর্ত জুড়ে দেয়। এগুলো দীর্ঘমেয়াদে গুরুত্বপূর্ণ হলেও ত্বরিত ফল প্রত্যাশী সরকারগুলোর কাছে কম গ্রহণযোগ্য।
তুরস্কের জটিল বাস্তবতা
তুরস্ক একদিকে ন্যাটো জোটের অংশীদার, আবার অন্যদিকে চীনের প্রতি আগ্রহী।
জ্বালানি ও অবকাঠামোতে চীনের বিনিয়োগ।
পশ্চিমা আর্থিক বাজারের টানাপোড়েনে চীনা ঋণ ও মুদ্রা-বিনিময় চুক্তির ওপর নির্ভরতা।
ভূরাজনৈতিক অবস্থান কাজে লাগিয়ে দুই পক্ষকেই প্রভাবিত করার কৌশল।
চীন কেন দক্ষিণে এগিয়ে যাচ্ছে?
দ্রুততা ও নমনীয়তা: দীর্ঘ আলোচনা ছাড়া দ্রুত প্রকল্প বাস্তবায়ন।
শর্তহীন অর্থায়ন: ইইউ’র কঠিন শর্তের বিপরীতে সহজ অর্থের যোগান।
কৌশলগত অবকাঠামো: বন্দর, রেলওয়ে, বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
বাণিজ্যিক শক্তি: অবকাঠামোর পাশাপাশি দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যে শক্তিশালী অবস্থান।
ইইউ’র সামনে চ্যালেঞ্জঃ মূল্যবোধ বনাম প্রতিযোগিতা
ইইউ নিজেকে মূল্যবোধ-ভিত্তিক অংশীদার হিসেবে উপস্থাপন করে—গণতন্ত্র, সুশাসন, পরিবেশবান্ধব উন্নয়নকে প্রাধান্য দেয়। কিন্তু এই কাঠামো চীনের দ্রুত, শর্তহীন বিনিয়োগের তুলনায় অনেক সময় পিছিয়ে যায়।
সম্ভাব্য পথ:
দক্ষিণ ভূমধ্যসাগরে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিজিটাল অবকাঠামোতে বেশি বিনিয়োগ।
দ্রুত ও নমনীয় অর্থায়নের নতুন ব্যবস্থা।
আফ্রিকান ইউনিয়ন ও আঞ্চলিক অংশীদারিত্ব জোরদার।
তুরস্কের সঙ্গে সংঘাত নয়, বরং সংলাপকেন্দ্রিক কৌশল।
বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য তাৎপর্য
এই ভিন্নমুখী গতিপথ বৈশ্বিক অর্থনীতিতে বহুমুখী প্রভাব বলয় সৃষ্টি করছে।
ইইউ মডেলঃ শাসনব্যবস্থা, স্থায়িত্ব, রাজনৈতিক একীকরণ।
চীন মডেলঃ দ্রুত ফল, অবকাঠামো, আর্থিক নমনীয়তা।
একক কোনো বিজয়ী নয়; বরং আঞ্চলিকভাবে ভিন্ন প্রভাব বলয় তৈরি হচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য শিক্ষা
বাংলাদেশের মতো উদীয়মান অর্থনীতির কাছে এই প্রতিযোগিতা থেকে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা পাওয়া যায়ঃ
বৈচিত্র্যময় অংশীদারিত্ব: একক জোটের ওপর নির্ভর না করে ইইউ ও চীনের দু’দিকেই সম্পর্ক জোরদার করা।
কৌশলগত স্বায়ত্তশাসন: জাতীয় অগ্রাধিকারকে প্রাধান্য দেওয়া।
ভৌগোলিক সুবিধা: বঙ্গোপসাগর ও দক্ষিণ এশিয়ার সেতু হিসেবে অবস্থান কাজে লাগানো।
দ্রুততা ও মানের ভারসাম্য: চীনের ত্বরিত উন্নয়ন ও ইইউ’র মাননির্ভর উন্নয়ন—উভয়ের সমন্বয় দীর্ঘমেয়াদে লাভজনক।
মডেল প্রতিযোগিতার লড়াই
পূর্ব ইউরোপে ইইউ’র সাফল্য প্রমাণ করে, সঠিক ভূরাজনৈতিক পরিস্থিতি তৈরি হলে ইউরোপ শক্তভাবে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। তবে উত্তর আফ্রিকা ও তুরস্কে চীনের শর্তহীন, দ্রুত ও কৌশলগত বিনিয়োগ ইইউ’র সীমাবদ্ধতাকে নগ্ন করে তুলেছে।
বিশ্ব অর্থনীতির এই প্রতিযোগিতা একক কোনো সমাধান দেবে না; বরং ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে ভিন্ন মডেল প্রভাবশালী হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর জন্য মূল শিক্ষা হলো—চটপটে কৌশল, বৈচিত্র্যময় সম্পর্ক এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতায় বিনিয়োগ।