যুক্তরাষ্ট্রের আপিল বিভাগ শুক্রবার (৫ সেপ্টেম্বর) ট্রাম্প প্রশাসনের একতরফাভাবে বৈদেশিক সহায়তা তহবিল স্থগিত করার বিরুদ্ধে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রেখেছে। এই রায়ের ফলে, কংগ্রেস অনুমোদিত প্রকল্পগুলির জন্য নির্ধারিত শত শত কোটি ডলার এখন খরচ করতে বাধ্য হবে ট্রাম্প প্রশাসন, যা কার্যত তার বিদেশি সাহায্য সংক্রান্ত নীতি পরিবর্তন করতে বাধ্য করবে। এ ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি, অর্থনীতি এবং বৈদেশিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোতে প্রভাব ফেলবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর নিশ্চিত করেছে।
ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া সার্কিটের আপিল আদালত জানায় যে, ট্রাম্প প্রশাসন নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত করার জন্য প্রয়োজনীয় শর্ত পূরণ করতে ব্যর্থ হয়েছে। তবে আপিল বিভাগের পক্ষ থেকে এই সিদ্ধান্তের পক্ষে কোনও ব্যাখ্যা দেওয়া হয়নি, যা মূলত এই আইনগত বিতর্কের জটিলতা আরও বাড়িয়েছে।
পৃথক বিচারের ভিন্নমত ও অবস্থান
মার্কিন প্রেসিডেন্টের নিযুক্ত সার্কিট বিচারপতি জাস্টিন ওয়াকার আপিল বিভাগের এই রায়ের বিরুদ্ধে ভিন্নমত পোষণ করেন। তিনি জানান, যদি এটি তাঁর হাতে থাকত, তবে তিনি নিম্ন আদালতের রায় স্থগিত রাখতেন, কারণ তার মতে, এটি দেশের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ।
এই ভিন্নমত প্রকাশের পর, বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন যে, যুক্তরাষ্ট্রের আদালতব্যবস্থা বৈদেশিক সাহায্য নীতি নিয়ে এক ধরনের অস্থিরতার মধ্যে রয়েছে, যেখানে রাজনৈতিক এবং আইনগত অবস্থানের দ্বন্দ্ব ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ট্রাম্প প্রশাসন, যিনি ক্ষমতায় আসার পর বৈদেশিক সহায়তা কমানোর জন্য কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছিলেন, তার প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির মধ্যে সীমাবদ্ধতার বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
ট্রাম্প প্রশাসনের বৈদেশিক সহায়তা নীতি ও পরিবর্তন
ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ট্রাম্প সরকার বৈদেশিক সহায়তার তহবিল ব্যাপকহারে কমিয়ে এনেছে। ২০১৭ সালে তার প্রশাসন একযোগে প্রায় ২ বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক সহায়তা কমানোর পরিকল্পনা নেয়। এটি তার “আমেরিকা ফার্স্ট” নীতির অঙ্গ হিসেবে প্রকাশ পায়, যেখানে আন্তর্জাতিক সহায়তার উপর যুক্তরাষ্ট্রের অতিরিক্ত ব্যয়ের বিরুদ্ধে তিনি সুর চড়ান। তবে বিভিন্ন সহায়তা সংস্থার আইনি পদক্ষেপের পর, প্রশাসন ২০২৪ সালের জন্য বরাদ্দ সাড়ে ছয়শ কোটি ডলার খরচ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
এছাড়া, মার্কিন সহায়তা সংস্থা ইউএসএআইডির প্রায় ৪০০ কোটি ডলার আটকে দিয়েছে হোয়াইট হাউজ, যা এখন বিলুপ্তির শেষ ধাপে রয়েছে। এই আটকে রাখা তহবিলের ব্যাপারে আইনগত জটিলতা সৃষ্টি হওয়ায়, ট্রাম্প প্রশাসন এখন তা দ্রুত খরচ করার জন্য বাধ্য হবে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন পরিস্থিতি আসলে প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির পরিবর্তনের সূচনা হতে পারে।
নিম্ন আদালতের রায় ও কংগ্রেসের অবস্থান
গত মাসে, এক নিম্ন আদালতের রায়ে বলা হয় যে, কংগ্রেস অনুমোদিত তহবিলের এক হাজার ১০০ কোটি ডলার সেপ্টেম্বরের মধ্যে খরচ করতে প্রশাসনকে পদক্ষেপ নিতে হবে। ওয়াশিংটন ডিসি জেলা আদালতের বিচারপতি আমির আলি বুধবার রায় দেন, যে প্রশাসন কেবল এক সিদ্ধান্তে অর্থ ব্যয় বন্ধ করতে পারে না। কংগ্রেস আইন পরিবর্তন না করা পর্যন্ত বরাদ্দ অর্থ ব্যয় করতে প্রশাসনকে বাধ্য করা উচিত।
এই রায়ের পর, এটি স্পষ্ট হয়েছে যে, ট্রাম্প প্রশাসন কংগ্রেসের অনুমোদিত অর্থ অন্যত্র ব্যবহার করতে বা আটকে রাখতে পারবেন না। বিষয়টি কংগ্রেসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ কারণ তাদের অনুমোদন ছাড়া কোনো তহবিলের ব্যবহার পরবর্তী সময়ে অবৈধ হতে পারে।
কংগ্রেসকে পাশ কাটিয়ে বৈদেশিক সহায়তা বাতিলের চেষ্টা
অন্যদিকে, ট্রাম্প প্রশাসন “পকেট রিসিশন” কৌশল ব্যবহার করে কংগ্রেসের অনুমোদন ছাড়াই বৈদেশিক সহায়তা আটকে রাখতে চায়। এর মাধ্যমে প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার আটকে রাখার পরিকল্পনা রয়েছে প্রশাসনের। এটি ট্রাম্প প্রশাসনের জন্য একটি সাধারণ কৌশল হলেও, কংগ্রেসে এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ তৈরি হয়েছে।
মার্কিন বাজেট পরিচালক রাসেল ভট দাবি করেছেন, যে প্রেসিডেন্ট চাইলে রিসিশনের আবেদন করে ৪৫ দিনের জন্য অর্থ আটকে রাখতে পারেন, যা কার্যত ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সময়ক্ষেপণ করবে এবং সেই সময়ের মধ্যে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হবে।
হোয়াইট হাউজের কৌশল এবং ১৯৭৭ সালের পূর্ববর্তী উদাহরণ
হোয়াইট হাউজ জানায়, এই “পকেট রিসিশন” কৌশল সর্বশেষ ১৯৭৭ সালে ব্যবহৃত হয়েছিল, যখন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার প্রশাসন একই ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিল। এটি একটি নির্দিষ্ট আইনি কৌশল, যার মাধ্যমে কোনো বিশেষ বাজেট বরাদ্দ আটকে রাখা যায়। তবে এই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কংগ্রেস ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থাগুলোর বিরোধিতা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের নির্দেশনা
এর আগে, মার্কিন সুপ্রিম কোর্টের পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনকে সহায়তা সংস্থাগুলোর প্রাপ্য অর্থ বুঝিয়ে দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এটি ছিল একটি ঐতিহাসিক রায়, যা মার্কিন সরকারের প্রতি আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করেছে।
এখন, এই নতুন রায়ের পর, প্রশাসনকে দ্রুত বৈদেশিক সহায়তা খরচ করতে হবে, এবং এতে কংগ্রেসের ভূমিকা আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বৈদেশিক সম্পর্কের গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলোর মধ্যে এই আইনি অস্থিরতা যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক নীতির ভবিষ্যতকেও প্রভাবিত করবে।
পাঠকের মন্তব্য