জাহিদুজ্জামান সাঈদ
এডিটর-ইন-চিফ, এন্ট্রেপ্রেনিয়র বাংলাদেশ
বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি। ঘূর্ণিঝড়, নদীভাঙন, বন্যা, খরা এবং লবণাক্ততা সরাসরি প্রভাব ফেলছে কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা ও গ্রামীণ অর্থনীতিতে। এই পরিস্থিতিতে সবুজ অর্থায়ন (Green Finance) কেবল পরিবেশ সুরক্ষার কৌশল নয়, বরং টেকসই অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য হাতিয়ার।
নারীরা—বিশেষ করে গ্রামীণ নারী উদ্যোক্তারা—ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগে (এসএমই) কৃষি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, হস্তশিল্প, পোশাক, খুচরা ব্যবসা এবং সেবাখাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছেন। অথচ পুঁজি, প্রশিক্ষণ এবং বাজারে প্রবেশাধিকারের ক্ষেত্রে তারা নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন। ফলে নারী-স্বত্বাধিকারী ব্যবসার জন্য সবুজ অর্থায়ন একটি নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
নারী উদ্যোক্তা ও সবুজ অর্থায়নের সম্ভাবনা
বাংলাদেশে প্রায় ২৫% ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ নারীদের মালিকানাধীন। বিশেষ করে কৃষিভিত্তিক শিল্প, দুগ্ধ ও পশুপালন, মৎস্য, পোশাক ও হস্তশিল্প খাতে তাদের অবদান দৃশ্যমান। সবুজ অর্থায়নের মাধ্যমে তারা—
জ্বালানি সাশ্রয়ী প্রযুক্তি (সোলার ড্রায়ার, সোলার কোল্ড স্টোরেজ, বায়োগ্যাস ইউনিট),টেকসই কৃষি চর্চা (জৈব সার, ড্রিপ সেচ, পুনর্জীবনশীল কৃষি),ইকো-ট্যুরিজম (পরিবেশবান্ধব রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁ), সবুজ সরবরাহ চেইন (বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পুনর্ব্যবহার) খাতে নেতৃত্ব দিতে পারেন। গবেষণায় দেখা গেছে, নারীরা পুরুষদের তুলনায় পরিবেশবান্ধব বিনিয়োগে বেশি আগ্রহী।
চ্যালেঞ্জসমূহ
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য সবুজ অর্থায়ন সহজ নয়। এর প্রধান প্রতিবন্ধকতাগুলো হলো: জামানতের অভাব: অধিকাংশ নারী উদ্যোক্তার নামে জমি বা সম্পত্তি নেই।আর্থিক সাক্ষরতার ঘাটতি: বাজেট, হিসাবরক্ষণ, নগদ প্রবাহ ব্যবস্থাপনায় সীমাবদ্ধতা। সামাজিক বাধা: পরিবার ও সমাজে বড় অঙ্কের আর্থিক সিদ্ধান্তে নারীদের অংশগ্রহণ সীমিত। পণ্য ও সেবার ঘাটতি: বেশিরভাগ আর্থিক প্রতিষ্ঠান এখনো নারী-স্বত্বাধিকারী সবুজ ব্যবসার জন্য নির্দিষ্ট পণ্য তৈরি করেনি।
বাংলাদেশে চলমান উদ্যোগ
বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সবুজ ঋণ নীতি গ্রহণ করেছে এবং ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে তাদের ঋণপোর্টফোলিওর নির্দিষ্ট অংশ সবুজ খাতে বরাদ্দ করতে বলেছে। এ ছাড়া—নারী উদ্যোক্তাদের জন্য রিফাইন্যান্স স্কিম চালু আছে, তবে সবুজ খাতে এর ব্যবহার সীমিত। কিছু এনজিও ও মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান নারীদের সৌরচুলা, বায়োগ্যাস, জৈব সার উৎপাদনের মতো পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় ঋণ দিচ্ছে।
আন্তর্জাতিকভাবে প্রচলিত সবুজ বন্ড, টেকসই বন্ড, ব্লু বন্ড বাংলাদেশেও ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে। এর মাধ্যমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি, পরিবেশবান্ধব অবকাঠামো, এমনকি সামুদ্রিক জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের মতো খাতে বিনিয়োগ সম্ভব।
বাংলাদেশে টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে এবং নারী উদ্যোক্তাদের বিশেষ করে গ্রামীণ নারী উদ্যোগগুলোকে এগিয়ে নিতে সরকারের এখনই কয়েকটি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
প্রস্তাবিত উদ্যোগসমূহ
বিশেষায়িত সবুজ ঋণ স্কিম
নারী উদ্যোক্তাদের জন্য পৃথকভাবে তৈরি সবুজ ঋণ সুবিধা চালু করা, যাতে তারা পরিবেশবান্ধব ব্যবসায় বিনিয়োগ করতে পারেন।
ডিজিটাল ফাইন্যান্স সেবা সম্প্রসারণ
জামানত ছাড়াই মোবাইল ব্যাংকিং ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সহজে ঋণপ্রাপ্তির সুযোগ নিশ্চিত করা।
আর্থিক সাক্ষরতা ও সবুজ প্রযুক্তি প্রশিক্ষণ
নারী উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বাড়াতে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, বাজেট পরিকল্পনা এবং সবুজ প্রযুক্তি বিষয়ে নিয়মিত প্রশিক্ষণ আয়োজন করা।
সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধি
অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে গণমাধ্যম, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও স্থানীয় পর্যায়ে সচেতনতামূলক কর্মসূচি চালানো।
সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব (PPP)
নারী-স্বত্বাধিকারী ব্যবসাকে সবুজ অর্থনীতির মূলধারায় আনতে সরকার ও বেসরকারি খাতের যৌথ উদ্যোগে প্রকল্প বাস্তবায়ন করা।
সবুজ অর্থায়ন বাংলাদেশের নারীদের জন্য কেবল ব্যবসায়িক সুযোগ নয়, বরং ক্ষমতায়ন ও জলবায়ু সহনশীলতার হাতিয়ার। বাংলাদেশ ব্যাংকের টেকসই আর্থিক নীতি, সবুজ ঋণ প্রকল্প এবং ভবিষ্যতে সবুজ বন্ড বাজারের প্রসার নারীদের জন্য একটি বড় সম্ভাবনা তৈরি করছে। যদি সঠিক নীতি, আর্থিক কাঠামো এবং প্রশিক্ষণ নিশ্চিত করা যায়, তবে নারী উদ্যোক্তারা সবুজ অর্থনীতিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে সক্ষম হবেন। এতে বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়ন, দারিদ্র্য হ্রাস ও লিঙ্গসমতা অর্জনের পথ আরও সুগম হবে।