বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাত বর্তমানে বড় ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। প্রতিবেশী ভারত ও নেপালের সঙ্গে বিদ্যুৎ আমদানি চুক্তি রয়েছে মোট ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াটের। এর মধ্যে গড়ে ৮০ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানি করে দেশের চাহিদা মেটানো হচ্ছে। অন্যদিকে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) নিজস্ব দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা ৬ হাজার ১১৪ মেগাওয়াট হলেও, বাস্তবে গত অর্থবছরে এর ব্যবহার হয়েছে মোট চাহিদার মাত্র ১৬ শতাংশের সামান্য বেশি।
প্লান্ট ফ্যাক্টর ও সংকট
বিদ্যুৎ খাতে ‘প্লান্ট ফ্যাক্টর’ একটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক। সাধারণত ৮০ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টর ধরে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করা হয়। কিন্তু বিপিডিবির কেন্দ্রগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর বর্তমানে নেমে এসেছে গড়ে ৩০ শতাংশে, আর চলতি না থাকা কেন্দ্রগুলো ধরলে তা ১৮ শতাংশের বেশি নয়। এ অবস্থায় উৎপাদনে না থেকেও বিপুল জনবল রক্ষণাবেক্ষণের খরচ বহন করতে হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটিকে।
কেন কমছে বিপিডিবির উৎপাদন?
বিপিডিবির কর্মকর্তারা বলছেন, বিদ্যুৎ কেন্দ্র থাকলেও বেশির ভাগ গ্যাস ও তেলভিত্তিক। গ্যাস সরবরাহ সংকট এবং তেলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর উচ্চ ব্যয় এ খাতকে অচল করে দিচ্ছে। বর্তমানে গ্যাসভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর প্লান্ট ফ্যাক্টর মাত্র ৩২ শতাংশ। ফার্নেস অয়েলভিত্তিক কেন্দ্রগুলোর সক্ষমতা ৭৪২ মেগাওয়াট হলেও এগুলো বছরে গড়ে মাত্র ১৭ শতাংশ প্লান্ট ফ্যাক্টরে চলেছে। ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো পুরোপুরি বন্ধ।
আমদানিনির্ভর বিদ্যুৎ
মোট ২ হাজার ৮০০ মেগাওয়াট আমদানি চুক্তির মধ্যে ভারতের আদানি গোষ্ঠীর সঙ্গেই রয়েছে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াট। সেখান থেকে গড়ে প্রতিদিন আসে প্রায় ১ হাজার ২০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। এছাড়া জিটুজি চুক্তিতে আরও ১ হাজার মেগাওয়াট এবং নেপাল থেকে আসে গড়ে ৩৮ মেগাওয়াট জলবিদ্যুৎ। এতে একদিকে বিদেশি বিল বেড়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে স্থানীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্র বসে থেকেও সরকারের ক্যাপাসিটি চার্জ বাড়ছে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম শামসুল আলম বলেন,
“বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক ব্যয়ের বড় চাপ এ খাতের অতিরিক্ত সক্ষমতা। সরকার যদি সময়মতো সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিতো, তবে আজকের এই চাপ সৃষ্টি হতো না।”
বুয়েটের অধ্যাপক ম. তামিম মনে করেন,
“বিপিডিবির তালিকার বড় অংশই অচল কেন্দ্র। এগুলো খাতা-কলমে আছে, কিন্তু বাস্তবে উৎপাদনে নেই। পুরনো কেন্দ্রগুলো ফেজ আউট করতে হবে।”
বিপিডিবির অবস্থান
বিপিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী রেজাউল করিম বলেন,
“গ্যাস সংকটের কারণে আমাদের অনেক কেন্দ্র চালানো যাচ্ছে না। ঘোড়াশাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রকে পুনরায় উৎপাদনে আনার চেষ্টা চলছে। তবে অনেক অদক্ষ কেন্দ্র পর্যায়ক্রমে অবসরে যাবে।”
সার্বিক চিত্র
২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট বিদ্যুৎ উৎপাদন ছিল প্রায় ৯৬ হাজার মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। এর মধ্যে বিপিডিবির অবদান মাত্র ১৫ হাজার ৮৩১ মিলিয়ন কিলোওয়াট-ঘণ্টা। অর্থাৎ দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিপিডিবির হিস্যা নেমে এসেছে ১৬ শতাংশে। আর্থিক ব্যয়ও তুলনামূলক কম, কারণ আইপিপি ও আমদানি খাতেই ব্যয়ের বড় অংশ যাচ্ছে।
উপসংহার
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতের অন্যতম শক্তি ছিল বিপিডিবি। কিন্তু আজ এটি দাঁড়িয়ে আছে আমদানিনির্ভরতার সংকটে। জ্বালানি সংকট, পুরনো কেন্দ্র ও অদক্ষ ব্যবস্থাপনা একে দুর্বল করছে। স্থানীয় সক্ষমতা বসিয়ে রেখে বিদেশি বিদ্যুতের ওপর নির্ভরশীলতা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতি ও জ্বালানি নিরাপত্তা—দুটোকেই ঝুঁকির মুখে ফেলতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য