বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় মানবিক সংকট রোহিঙ্গা ইস্যু। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে নির্যাতিত হয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা মানুষের জীবন এখনো অনিশ্চয়তায় ঘেরা। তারা নিরাপত্তাহীনতা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানহীনতা এবং শরণার্থী জীবনের অসহায় বাস্তবতায় দিন পার করছে। এই দীর্ঘমেয়াদি সংকটের টেকসই সমাধান খুঁজে বের করতে আবারও আন্তর্জাতিক মহলে শক্ত বার্তা পৌঁছে দিতে উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
এই লক্ষ্যেই আগামী ২৪ থেকে ২৬ আগস্ট কক্সবাজারে আয়োজন করা হয়েছে তিন দিনব্যাপী আন্তর্জাতিক রোহিঙ্গা কনফারেন্স। এতে যোগ দেবেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি ২৫ আগস্ট একদিনের সফরে কক্সবাজারে গিয়ে কনফারেন্সে অংশ নেবেন।
বৃহস্পতিবার (২১ আগস্ট) ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠক শেষে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বিষয়টি নিশ্চিত করেন। তিনি জানান, এ কনফারেন্সে রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা বৃদ্ধি, নিরাপদ প্রত্যাবাসন নিশ্চিতকরণ এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সাড়া আরও জোরদার করার বিষয়গুলো গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হবে।
মানবিক সংকটের ভয়াবহতা
২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নিপীড়ন থেকে পালিয়ে লাখো রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। সেই থেকে কক্সবাজার বিশ্বের সবচেয়ে বড় শরণার্থী শিবিরে পরিণত হয়েছে। শিশু ও নারীরা বিশেষভাবে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপত্তার ঘাটতি প্রতিদিন নতুন চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ওপরও চাপ বেড়েছে বহুগুণে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহযোগিতা কিছুটা থাকলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা কমে আসছে। অথচ সংকটের কোনো কার্যকর সমাধান এখনো দৃশ্যমান নয়। ঠিক এই সময়ে কক্সবাজারে আয়োজিত এই কনফারেন্স রোহিঙ্গা ইস্যুতে নতুন করে আন্তর্জাতিক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করবে বলে আশা করা হচ্ছে।
বড় পরিসরে কূটনৈতিক উপস্থিতি
কক্সবাজারে অনুষ্ঠেয় এ সম্মেলনে বিশ্বের প্রায় ৪০টি দেশের প্রতিনিধি উপস্থিত থাকবেন। এর মধ্যে বাংলাদেশে নিযুক্ত অন্তত ১০ জন রাষ্ট্রদূতও অংশ নেবেন। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা, জাতিসংঘের বিভিন্ন অঙ্গসংস্থা এবং উন্নয়ন সহযোগীরা যোগ দেবেন বলে আয়োজকদের প্রত্যাশা।
প্রেস সচিব শফিকুল আলম আরও জানান, শুধু কক্সবাজারেই নয়, সামনে আরও দুটি বড় কনফারেন্স আয়োজনের পরিকল্পনা রয়েছে। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বিশ্বের ১৭০ দেশের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া কাতারের দোহাতেও আরেকটি সম্মেলন আয়োজন করা হবে।
মানবিক বার্তা ও প্রত্যাশা
রোহিঙ্গাদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনই এখন বাংলাদেশের প্রধান দাবি। তবে শুধু ফেরত পাঠানোই যথেষ্ট নয়, তাদের নিরাপত্তা ও নাগরিক অধিকার নিশ্চিত করাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। মানবিক সহায়তা, শিক্ষার সুযোগ এবং মানসিক স্বাস্থ্যের বিষয়গুলোও সমান গুরুত্বপূর্ণ।
প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বিশ্বাস করেন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত উদ্যোগ ছাড়া এ সংকটের সমাধান সম্ভব নয়। তাঁর অংশগ্রহণ রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকারের দৃঢ় অবস্থান এবং মানবিক দায়বদ্ধতারই প্রতিফলন।
উপসংহার
রোহিঙ্গা সমস্যা শুধু বাংলাদেশের নয়, এটি একটি বৈশ্বিক মানবিক সংকট। কক্সবাজারে আয়োজিত এ কনফারেন্স বিশ্বকে আবারও মনে করিয়ে দেবে যে, লাখো রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশুর জীবন এখনো ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। এই কনফারেন্স মানবিক সহানুভূতি জাগিয়ে আন্তর্জাতিক সমর্থন ও কার্যকর সমাধানের পথ উন্মোচন করবে বলে আশা করা যায়।
পাঠকের মন্তব্য