সংগ্রাম, ত্যাগ, শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসায় ৮১ বছরে পা রেখেছেন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) চেয়ারপার্সন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। আজ শুক্রবার (১৫ আগস্ট) সাবেক এই প্রধানমন্ত্রীর ৮১তম জন্মদিন পালিত হচ্ছে। জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকাসহ দেশব্যাপী দলীয় কার্যালয় ও মসজিদে মিলাদ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হবে।
বিএনপি জানিয়েছে, এবারের জন্মদিনে কেক কাটা হবে না। এই দোয়া ও মিলাদ মাহফিলে মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৯০ সালের গণ-আন্দোলন এবং ২০২৪ সালের গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের রুহের মাগফিরাত এবং আহতদের সুস্থতা কামনা করা হবে। কেন্দ্রীয়ভাবে নয়াপল্টনের বিএনপি কার্যালয়ে সকাল ১১টায় দোয়া মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট দিনাজপুরে এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার মা চন্দনবাড়ির মেয়ে তৈয়বা মজুমদার, পিতা ফেনীর ফুলগাজির ইস্কান্দার মজুমদার। সুরেন্দ্রনাথ কলেজে পড়ার সময় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। তাদের দুই সন্তান—বিএনপি’র ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান এবং মরহুম আরাফাত রহমান কোকো।
১৯৮১ সালের ৩১ মে বিএনপি’র প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমান বিপথগামী সেনা সদস্যদের হাতে শাহাদাত বরণ করলে বেগম খালেদা জিয়া সাধারণ গৃহবধূর জীবন ছেড়ে রাজপথে রাজনীতি শুরু করেন। ১৯৮২ সালের ৩ জানুয়ারি তিনি বিএনপি-তে প্রাথমিক সদস্যপদ গ্রহণ করেন। ১৯৮৪ সালে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় বিএনপি চেয়ারপার্সন নির্বাচিত হন।
বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। ‘আপসহীন’ নেত্রী হিসেবে তিনি মানুষের ন্যায়বিচার ও গণতন্ত্রের পক্ষে রুখে দাঁড়ান। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। তিনি এ পর্যন্ত তিনবার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।
১৯৯৩ সালে তিনি সার্কের প্রথম নারী চেয়ারপার্সন হন। ২০০১ সালে তৃতীয়বার সরকার গঠন করেন। ওয়ান-ইলেভেনের পর ফখরুদ্দীন সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর কারাবন্দি হন এবং ২০০৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত কারাভোগ করেন।
২০০৮ সালের ডিসেম্বরে নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি কাঙ্ক্ষিত ফল না পেয়ে সরকার গঠনে ব্যর্থ হয়। এরপর দুদক মামলায় দণ্ডিত হয়ে ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মাত্র দুই কোটি টাকার ‘সাজানো মামলার ফরমায়েশী’ রায়ে কারারুদ্ধ হন। পুরোনো কারাগারে স্যাঁতসেঁতে পরিবেশে বিনা চিকিৎসায় থাকার কারণে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বিদেশে উন্নত চিকিৎসার সুপারিশ করলেও, বারবার পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন নাকচ করে দেন সরকারের পক্ষ। দেশে করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ শুরু হলে, ছয় মাসের জন্য সাজা স্থগিত করে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ শর্তসাপেক্ষে মুক্তি পান। এই সময় তাকে গুলশানের ভাড়া বাসা ‘ফিরোজা’-য় রাখা হয়। হাসপাতালে নেওয়া হলেও বাসায় বন্দী রাখার কারণে তিনি সবসময় চিকিৎসার প্রাপ্য সেবা থেকে বঞ্চিত হন।
বেগম খালেদা জিয়ার শারীরিক অসুস্থতার ইতিহাস দীর্ঘ। তিনি লিভার সিরোসিস, কিডনি, হার্ট, ডায়াবেটিস ও আর্থ্রাইটিসসহ নানা রোগে ভুগছেন। ২০২৫ সালের ৮ জানুয়ারি উন্নত চিকিৎসার জন্য যুক্তরাজ্যের লন্ডনে যান। কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল থানির পাঠানো বিশেষ এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে লন্ডনে পৌঁছান এবং চার মাসের চিকিৎসার পর ৬ মে দেশে ফেরেন। যুক্তরাজ্যের লন্ডনে তিনি তারেক রহমানের বাসায় ছিলেন। লন্ডন ক্লিনিকের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক অধ্যাপক প্যাট্রিক কেনেডি ও অধ্যাপক জেনিফার ক্রস তত্ত্বাবধানে ছিলেন।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক জীবন সংগ্রাম ও ত্যাগের এক অসামান্য উদাহরণ। ১৯৮০-এর দশক থেকে শুরু করে ২০২০-এর দশক পর্যন্ত বাংলাদেশের রাজনীতিতে তার অবদান অসামান্য। তিনি শুধু নারী নেতৃত্বের প্রতীক নন, বরং গণতন্ত্র, মানবাধিকার ও দলীয় নীতির প্রতি অবিচল থাকায় তিনি দেশজুড়ে সমাদৃত।
বিগত দেড় দশক ধরে তার জন্মদিন নিয়েও রাজনৈতিক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। ১৫ আগস্ট জন্মদিন পালনের কারণে তিনি ও দলের নেতা-কর্মীরা বহুবার মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। তবু সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে তিনি দেশবাসীর হৃদয়ে অমর হয়েছেন।
বেগম খালেদা জিয়ার ৮১তম জন্মদিনের মিলাদ ও দোয়া মাহফিলে অংশগ্রহণের মাধ্যমে দেশের মানুষ তার দীর্ঘ রাজনৈতিক যাত্রা, সংগ্রাম, সাহসিকতা এবং নেতৃত্বকে শ্রদ্ধা জানাবে।
পাঠকের মন্তব্য