গণতন্ত্রের প্রথম শর্তই একটি অবাধ, নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন। তবে বিগত এক যুগে দলীয় সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত পরপর তিনটি জাতীয় নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ এবং ২০২৪ সাল) বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থার প্রতি জনগণের আস্থাকে চরমভাবে আঘাত করে। ফলস্বরূপ, নির্বাচনী ব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ অনেকাংশে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় বলে মনে করে নির্বাচন কমিশন।
জুলাই বিপ্লব ও অন্তর্বর্তী সরকারের আবির্ভাব
২০২৪ সালের জুলাই মাসে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে সূচিত হয় জুলাই গণবিপ্লব। এই আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে আওয়ামী লীগ সরকার ও শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন, এবং গঠিত হয় একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। একই সময় দায়িত্ব নেয় নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি), যার লক্ষ্য ছিল ধ্বংসপ্রাপ্ত গণতান্ত্রিক কাঠামো পুনর্গঠন।
আওয়ামী লীগের নিবন্ধন স্থগিত: রাজনীতির সমীকরণে বড় পরিবর্তন
নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, আওয়ামী লীগ দলীয় কর্মকাণ্ডে সরকারের নিষেধাজ্ঞা থাকায় দলটির নিবন্ধন স্থগিত রাখা হয়েছে। ফলে তারা ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
তবে ‘নৌকা’ প্রতীক সংরক্ষিত থাকলেও সেটি অন্য কেউ ব্যবহার করতে পারবে না বলে জানায় ইসি।
নির্বাচন কাঠামো পুনর্গঠন: এক বছরের কাজের খতিয়ান
ইসি জানায়, দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে তারা তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করছে:
-
নির্বাচনী বিধি ও আইন কঠোরভাবে প্রয়োগ করা
-
তরুণ সমাজ ও প্রবাসীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা
-
জনগণের ভোটাধিকার ফিরিয়ে আনা
২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর শপথ নেওয়ার পর থেকেই ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন উপলক্ষে শুরু হয় ইসির প্রাথমিক প্রস্তুতি।
নির্বাচনী সংস্কার ও প্রস্তুতি: বিস্তারিত বিশ্লেষণ
নতুন ভোটার ও প্রবাসীদের অন্তর্ভুক্তি
-
৪৪ লাখ ৬৬ হাজার নতুন ভোটার এবার তালিকায় যুক্ত হয়েছে।
-
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে পোস্টাল ব্যালটের মাধ্যমে ভোট দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। এই প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় ৪৮ কোটি টাকা।
সীমানা পুনর্নির্ধারণ ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ
-
৩৯টি সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণের খসড়া অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
-
১০ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ, ৩১ আগস্টের মধ্যে চূড়ান্ত তালিকা ঘোষণা।
রাজনৈতিক দল নিবন্ধন প্রক্রিয়া
-
১৪৫টি রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে।
-
৮০টি দল ঘাটতি পূরণ করেছে, ৬টি সময় চেয়েছে, এবং ৫৯টি দল কোনো জবাব দেয়নি।
নতুন আচরণ বিধিমালা ২০২৫: সুষ্ঠু নির্বাচনের রূপরেখা
নতুন আচরণবিধিতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক রয়েছে:
-
পোস্টার ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা
-
দেড় লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানার বিধান
-
পরিবেশবান্ধব উপকরণের বাধ্যবাধকতা
-
এইচএসসি পাস ও ন্যূনতম বয়স ২১ বছর হলেই পর্যবেক্ষক হওয়ার যোগ্যতা
বাজেট ও লজিস্টিক প্রস্তুতি
-
মোট বরাদ্দ: ২,৯৫৬ কোটি টাকা
-
পরিচালন খাতে: ২,৭২৬.৯৫ কোটি টাকা
-
উন্নয়ন খাতে: ২২৯.০৫ কোটি টাকা
-
-
৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে সব নির্বাচনী সামগ্রী সংগ্রহের লক্ষ্য নির্ধারণ।
নির্বাচন কমিশনের বার্তা: “দিনের ভোট দিনে হবে”
প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বিভিন্ন বক্তব্যে নির্বাচনকে ঘিরে তার অবস্থান স্পষ্ট করেছেন:
“আমরা ১৫ বছর ধরে লড়াই করেছি ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। আজ আমরা অর্ধেক পথ অতিক্রম করেছি। সেই দিনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে যেদিন ভোটাররা স্বাধীনভাবে কেন্দ্রে গিয়ে ভোট দিয়ে আসতে পারবে।”
তিনি আরও বলেন:
“আমরা রাতের আঁধারে কিছু করতে চাই না। দিনের আলোতেই সব কার্যক্রম হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করেই সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দিতে চাই।”
আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ ও অংশগ্রহণ
-
ইইউ পর্যবেক্ষক দল সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে বাংলাদেশে আসবে।
-
তিনজন বিদেশি ও চারজন স্থানীয় পর্যবেক্ষক অংশ নেবেন নির্বাচনপূর্ব পরিবেশ পর্যবেক্ষণে।
প্রশাসনিক কর্তৃত্ব ও প্রশিক্ষণ
-
ভোটকেন্দ্র স্থাপনে ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের একক কর্তৃত্ব পুনর্বহাল করা হয়েছে।
-
জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারদের পূর্ববর্তী কর্তৃত্ব বাতিল করে ইসি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছে।
-
ভোটগ্রহণ কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ শুরু হচ্ছে শীঘ্রই।
উপসংহার: নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার পথে বাংলাদেশ
১৫ বছরের অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে বাংলাদেশ এখন একটি গণতান্ত্রিক নবজাগরণের দ্বারপ্রান্তে। অন্তর্বর্তী সরকার ও নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে দেশের জন্য একটি মাইলফলক ঘটনা। স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন আয়োজনে সবার সহযোগিতায় বাংলাদেশ একটি নতুন দিগন্তে পা রাখার অপেক্ষায়।
পাঠকের মন্তব্য