আমরা প্রতিদিনই আমাদের হাত-পা নাড়াচাড়া করি, হাঁটি, কথা বলি, শ্বাস নেই—সবকিছুই খুব স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু যদি হঠাৎ এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখেন, পা নড়ছে না, হাত তুলতে পারছেন না, এমনকি নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে—তাহলে সেটি হতে পারে গিয়ান-বারে সিনড্রোম বা সংক্ষেপে জিবিএস, এমন এক মারাত্মক স্নায়ুরোগ যা মানুষকে মুহূর্তেই প্যারালাইজড করে দিতে পারে।
জিবিএস রোগটি আমাদের শরীরের পেরিফেরাল স্নায়ুতন্ত্রে আক্রমণ চালায়—অর্থাৎ সেই স্নায়ুতে, যা মস্তিষ্ক থেকে শরীরের প্রত্যেক অঙ্গকে বার্তা পাঠায়। এক কথায় বলা যায়, এটি মানবদেহের “মাদারবোর্ডে” শর্ট সার্কিটের মতো।
কেমনভাবে শুরু হয় রোগটি
ব্রিটেনের জাতীয় স্বাস্থ্য সেবা (NHS) জানায়, রোগের শুরুটা অনেক সময়েই পা থেকে হয়। প্রথমে দুই পায়ের পাতা ভারী লাগে, তারপর ঝিনঝিন ও অসাড়তা শুরু হয়। কয়েক দিনের মধ্যেই এ অসাড়তা উপরের দিকে ছড়িয়ে পড়ে—হাঁটতে কষ্ট হয়, হাত নড়াতে পারেন না, এমনকি মুখের পেশীও কাজ করা বন্ধ করে দেয়।
অনেক সময় আক্রান্তের শ্বাসপ্রশ্বাস দুর্বল হয়ে যায়, ফলে তাকে ভেন্টিলেশনে রাখতে হয়। কেউ কেউ আবার খাবার গিলতে বা কথা বলতেও পারেন না। একপর্যায়ে পুরো শরীরই প্যারালাইজড হয়ে পড়ে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ৩০ থেকে ৩৫ বছর বয়সীদের মধ্যে এ রোগ বেশি দেখা যায় এবং পুরুষদের আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি নারীদের তুলনায় কিছুটা বেশি।
কেন হয় গিয়ান-বারে সিনড্রোম?
চিকিৎসকরা এখনো এ রোগের সুনির্দিষ্ট কারণ খুঁজে পাননি। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এটি ভাইরাস বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণের পরে দেখা দেয়।
যেমন—
-
এইডস, হার্পিস সিম্প্লেক্স বা জিকা ভাইরাস
-
ডায়রিয়া সৃষ্টিকারী ক্যাম্পাইলোব্যাক্টর জেজুনি
-
ইনফ্লুয়েঞ্জা বা সাধারণ ফ্লু
-
এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফ্লুর টিকা নেয়ার পরও দেখা দিতে পারে (যদিও এ সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ)।
বিশেষজ্ঞদের মতে, এসব সংক্রমণের পর শরীরের ইমিউন সিস্টেম ভুলবশত নিজের স্নায়ুতন্ত্রকেই শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে, এবং আক্রমণ শুরু করে। এর ফলেই পেশী দুর্বল হতে শুরু করে, তারপর আসে পক্ষাঘাত।
কীভাবে শনাক্ত করা যায়
জিবিএস প্রাথমিক পর্যায়ে শনাক্ত করা বেশ কঠিন। কারণ উপসর্গগুলো সাধারণ দুর্বলতা বা ক্লান্তির মতো মনে হতে পারে।
চিকিৎসকরা সাধারণত নিচের কিছু পরীক্ষা করে থাকেন—
-
স্নায়বিক রিফ্লেক্স টেস্ট (শরীরের প্রতিক্রিয়া দেখা)
-
ইলেক্ট্রিক্যাল টেস্ট (স্নায়ুর কার্যকারিতা যাচাই)
-
স্পাইরোমেট্রি (ফুসফুসের কার্যক্ষমতা পরিমাপ)
-
লাম্বার পাংচার—রোগীর মেরুদণ্ড থেকে তরলের নমুনা নিয়ে পরীক্ষা করা হয়, যা নির্ণয়ে সহায়ক ভূমিকা রাখে।
যদি এসব পরীক্ষায় জিবিএস ধরা পড়ে, তবে দ্রুত একজন নিউরোলজি বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিতে হয়।
চিকিৎসা ও আশার খবর
জিবিএসের চিকিৎসা এখনও বিরল ও জটিল। তবে সময়মতো সঠিক চিকিৎসা শুরু হলে সম্পূর্ণ সেরে ওঠা সম্ভব।
মূল চিকিৎসা হলো ইমিউনোথেরাপি, যেখানে রোগীর শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা যেন আর নিজের স্নায়ুকে আক্রমণ না করে, সেটি নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এজন্য দুটি চিকিৎসা প্রচলিত—
-
ইমিউনোগ্লোবুলিন থেরাপি (IVIG)
-
প্লাজমা এক্সচেঞ্জ (Plasmapheresis)
এছাড়া রোগীর ব্যথা, রক্ত জমাট বাঁধা বা শ্বাসকষ্ট নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য নিয়মিত ওষুধ ও চিকিৎসা দেয়া হয়।
যদি রোগী হাঁটতে না পারেন, তখন ফিজিওথেরাপি অত্যন্ত কার্যকর। এটি মাংসপেশির শক্তি ফিরিয়ে আনে এবং শুকিয়ে যাওয়া প্রতিরোধ করে।
সময়মতো চিকিৎসায় জীবনে ফেরার সম্ভাবনা
চিকিৎসকরা বলছেন, যদি উপসর্গের ৭ থেকে ১৪ দিনের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা যায়, তাহলে ৯০ শতাংশ রোগীই সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে ওঠেন।
কেউ কেউ দুই থেকে তিন সপ্তাহের মধ্যেই হাঁটতে শুরু করেন, আবার গুরুতর ক্ষেত্রে পুরোপুরি সুস্থ হতে ছয় মাস থেকে এক বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে।
তবে চিকিৎসা দেরি হলে কিছু শারীরিক দুর্বলতা স্থায়ীভাবে থেকে যেতে পারে। আর শ্বাসকষ্ট বা রক্ত সংক্রমণজনিত জটিলতায় মৃত্যুঝুঁকিও থেকে যায়।
এ কারণে বিশেষজ্ঞরা বলেন—
“হঠাৎ পা বা হাত দুর্বল লাগলে, ঝিনঝিন বা অসাড়তা শুরু হলে দেরি না করে স্নায়ুরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে যেতে হবে।”
মানুষের গল্পের ভেতরে বিজ্ঞান
গিয়ান-বারে সিনড্রোম শুধু একটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিষয় নয়, এটি মানবিক এক সংগ্রামের গল্প। হঠাৎ হাঁটতে না পারা, নিজের হাত নাড়াতে না পারা কিংবা নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট—এ অভিজ্ঞতা শুধু রোগী নয়, পুরো পরিবারের জীবন বদলে দেয়।
তবু আশার কথা, প্রযুক্তি ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ এ রোগের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। দ্রুত শনাক্তকরণ, আইসিইউ সাপোর্ট এবং ইমিউনোথেরাপির মাধ্যমে আজ অনেকেই নতুনভাবে হাঁটতে, হাসতে এবং বাঁচতে পারছেন।
উপসংহার
গিয়ান-বারে সিনড্রোম হয়তো বিরল, কিন্তু এর প্রভাব ভয়াবহ। তাই শরীরের হঠাৎ পরিবর্তনকে কখনো অবহেলা করবেন না।
সময়মতো চিকিৎসাই পারে পক্ষাঘাতের এই অদৃশ্য শত্রুর হাত থেকে জীবন বাঁচাতে।
পাঠকের মন্তব্য