বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে আজ রচিত হলো এক নতুন অধ্যায়। দীর্ঘ আলাপ-আলোচনা, মতবিনিময় ও ত্যাগের ধারাবাহিকতায় অবশেষে শুক্রবার (১৮ অক্টোবর) জাতীয় সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্লাজায় অনুষ্ঠিত হলো জুলাই জাতীয় সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠান—যা দেশের ভবিষ্যৎ গণতান্ত্রিক কাঠামো ও প্রশাসনিক সংস্কারের এক ঐতিহাসিক পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
এই সনদে স্বাক্ষর করেছেন দেশের প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর শীর্ষ নেতারা। বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরু, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি, এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না—সবাই একমত হয়েছেন, এই সনদ বাস্তবায়িত হলে বাংলাদেশে গণতন্ত্র ও সুশাসনের এক নতুন দিগন্ত উন্মোচিত হবে।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন,
“আজকের এই সনদ স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে গোটা জাতির আকাঙ্ক্ষা পূরণের পথে আমরা প্রথম পদক্ষেপ নিলাম। এই সনদ রাষ্ট্র কাঠামোতে ভারসাম্য ও জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠা করবে।”
তিনি আরও বলেন, “অন্তর্বর্তী সরকার ও জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের মাসব্যাপী কঠোর পরিশ্রম আজ জাতিকে দিয়েছে একটি নতুন দিকনির্দেশনা।”
অন্যদিকে, জামায়াতের নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের মতে,
“এই সনদ যদি সত্যিকার অর্থে বাস্তবায়িত হয়, তাহলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন ঘটবে। জনগণের আস্থা ফিরে আসবে রাজনীতিতে।”
তিনি সতর্ক করে বলেন, “সরকার যদি সনদের বাস্তবায়নে বিলম্ব করে, তাহলে সেটি হবে জাতির সঙ্গে গাদ্দারি।”
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুরু বলেন,
“এই সনদ শুধু একটি দলিল নয়, এটি শহীদের রক্তে লেখা একটি প্রতিশ্রুতি। এখানে শহীদ পরিবার, আহত ও জুলাই যোদ্ধাদের মর্যাদা ও সুরক্ষার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করায় আমরা কৃতজ্ঞ।”
তিনি উল্লেখ করেন, “এই সনদ আমাদের গণঅভ্যুত্থানের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার পথে প্রথম ভিত্তিপ্রস্তর।”
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন,
“জুলাই সনদ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমরা গণভোট ও নির্বাচন একসঙ্গে করার নীতিগত ঐকমত্যে পৌঁছেছি। এর মাধ্যমে জনগণের মতামতই হবে রাষ্ট্রের মূল ভিত্তি।”
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেন, “আগামী ৩০ অক্টোবরের মধ্যে আমরা বাস্তবায়নের পথচিত্র সম্পূর্ণ করব।”
নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না কিছুটা সমালোচনাও করেন, তবে আশা প্রকাশ করে বলেন,
“কিছু বিশৃঙ্খলা থাকলেও আজকের দিনটি বাংলাদেশকে নতুন আশার পথে নিয়ে গেছে। সনদটি একটি প্রতিশ্রুতির দলিল, যেখানে জনগণের কণ্ঠস্বর প্রতিফলিত হয়েছে।”
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মানবিক আবেগের স্রোত ছিল প্রবল। সংসদ ভবনের দক্ষিণ প্রান্তে ভিড় করা অসংখ্য তরুণ-যুবক, মুক্তিযোদ্ধা, জুলাই যোদ্ধা, শহীদ পরিবারের সদস্যরা কাঁধে পতাকা আর চোখে অশ্রু নিয়ে প্রত্যক্ষ করেছেন বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যাত্রার এই নতুন সূচনা।
এই সনদের মধ্য দিয়ে দেশের রাজনৈতিক দলগুলো সম্মিলিতভাবে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে—
-
রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গের মধ্যে ভারসাম্য বজায় থাকবে
-
সংবিধান সংস্কার করে জনগণের মতামতকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে
-
আইনের শাসন ও মানবাধিকারের নিশ্চয়তা নিশ্চিত হবে
-
গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালী করা হবে
অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অনুষ্ঠানে বলেন,
“আজকের এই সনদ শুধু একটি দলিল নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিপক্বতার প্রতীক। কিছু দল অনুপস্থিত থাকলেও আলোচনার দরজা খোলা রয়েছে।”
একটি দীর্ঘ অস্থিরতার পর আজকের এই ঐক্য জাতির সামনে নতুন সম্ভাবনা উন্মোচন করেছে। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাসের দেয়াল ভেঙে গঠিত এই সনদ হয়তো হতে পারে বাংলাদেশের পরবর্তী প্রজন্মের গণতন্ত্রের ভিত।
পাঠকের মন্তব্য