আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার আসামি যে সেনা কর্মকর্তাদের সেনানিবাসে সেনা হেফাজতে রাখা হয়েছে, তাদের দ্রুত বেসামরিক আদালতে হাজির করার আহ্বান জানিয়েছে জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশন (UN Human Rights Commission)।
বুধবার প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে সংস্থাটি জানায়, নিরপেক্ষ ও স্বচ্ছ বিচার নিশ্চিত করতে আটক সেনা কর্মকর্তাদের সেনা হেফাজতে না রেখে বেসামরিক আদালতের অধীনে আনা জরুরি।
জাতিসংঘের প্রতিক্রিয়া
কমিশনের মুখপাত্র রাভিনা সামদানি বলেন,
“গত সরকারের সময় সংঘটিত গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনের মামলায় অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের যথাসময়ে বেসামরিক আদালতে হাজির করাটা একটি ন্যায়বিচারমূলক পদক্ষেপ। এতে বিচারপ্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা নিশ্চিত হবে।”
জাতিসংঘের মতে, এই মামলাগুলো বাংলাদেশের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় খুলেছে, যেখানে ‘গুম’ ও ‘নির্যাতনের’ মতো গুরুতর অভিযোগে প্রথমবারের মতো আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া শুরু হলো।
পটভূমি
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় বিরোধী রাজনৈতিক মতাদর্শের মানুষদের গুম, গোপন আটক ও নির্যাতনের অভিযোগে তিনটি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলা দায়ের হয়। প্রসিকিউশনের অভিযোগ আমলে নিয়ে গত বুধবার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল ২৫ জন সাবেক ও বর্তমান সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করে।
এরপর শনিবার সেনা সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, ওই ২৫ জনের মধ্যে চাকরিরত ১৫ জনকে সেনা হেফাজতে নেওয়া হয়েছে। পরদিন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক প্রজ্ঞাপনে ঢাকা সেনানিবাসের একটি ভবনকে সাময়িক কারাগার হিসেবে ঘোষণা করা হয়।
বিতর্ক ও প্রতিক্রিয়া
এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে ব্যাপক বিতর্ক।
এক্স-ফোর্সেস অ্যাসোসিয়েশন মঙ্গলবার সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, অভিযুক্ত কর্মকর্তাদের বিচার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে নয়, বরং সেনা আইনে হওয়া উচিত।
এদিকে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) উদ্বেগ জানিয়ে বলেছে, সেনা সদস্যদের জন্য আলাদা কারাগার ঘোষণা ও বিচারে বিশেষ ব্যবস্থাপনা আইনের সমতার নীতির পরিপন্থী হতে পারে।
‘জবাবদিহিতার পথে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ’
জাতিসংঘ মানবাধিকার কমিশনের মতে, গুম ও নির্যাতনের মতো মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনায় এই বিচার “জবাবদিহিতা নিশ্চিতের পথে একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ”।
রাভিনা সামদানি বলেন,
“এটা শুধু একটি মামলার বিষয় নয়—এটা ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত। আমরা চাই, বিচার যেন হয় নিরপেক্ষ, মানবিক ও আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে।”
তিনি আরও বলেন,
“ভুক্তভোগী, সাক্ষী এবং অভিযুক্ত সবার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। কেউ যেন নির্বিচারে আটক না থাকে, সেটিও নিশ্চিত করা জরুরি।”
আন্তর্জাতিক আহ্বান
জাতিসংঘ কমিশন আবারও বাংলাদেশের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে—
-
যেন কোনো মামলায় মৃত্যুদণ্ড দাবি না করা হয়,
-
গুম থেকে ফেরা ব্যক্তিদের ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা হয়,
-
এবং রাজনৈতিক পরিচয় বা মতের কারণে কেউ হয়রানির শিকার না হয়।
রাভিনা সামদানি বলেন,
“আমরা গত বছর বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নেতৃত্বে প্রাণঘাতী বিক্ষোভের পর বলেছিলাম—মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত সবাইকে আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে জবাবদিহির আওতায় আনতে হবে। এই বিচার সেই প্রক্রিয়ারই অংশ।”
সামনে যা আসছে
অন্তবর্তীকালীন সরকারকে জাতিসংঘ আহ্বান জানিয়েছে, গুম, নির্যাতন ও রাজনৈতিক সহিংসতার মতো ঝুলে থাকা মামলাগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নিষ্পত্তি করতে।
মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, এই পদক্ষেপ বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থা ও গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিতে একটি ‘টার্নিং পয়েন্ট’ হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে—যদি বিচার প্রক্রিয়া নিরপেক্ষ, মানবিক ও স্বচ্ছভাবে সম্পন্ন হয়।
পাঠকের মন্তব্য