বিদেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের ক্ষেত্রে ভিসা জটিলতা দ্রুত নিরসনে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিশেষ উদ্যোগ নিতে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ে বুধবার অনুষ্ঠিত স্বল্পোন্নত দেশ (এলডিসি) থেকে বাংলাদেশের উত্তরণকে মসৃণ ও টেকসই করার লক্ষ্যে গঠিত জাতীয় স্টিয়ারিং কমিটির সভায় তিনি এ নির্দেশ দেন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা নিজে। এতে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ব্যবসায়ী ও শিল্পখাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন।
ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা দূর করার আহ্বান
সভা-পরবর্তী ব্রিফিংয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, “কিছু দেশে আমাদের শ্রমিক পাঠানোর প্রক্রিয়ায় জটিলতা রয়েছে, যা আগের সরকারের সময় থেকেই চলছে। প্রধান উপদেষ্টা চান এই সমস্যা দ্রুত সমাধান হোক।”
তিনি জানান, পূর্ব ইউরোপের কয়েকটি দেশে বাংলাদেশের শ্রমবাজার সম্প্রসারণের সুযোগ তৈরি হয়েছে। সম্প্রতি নিউইয়র্ক সফরে ড. ইউনূস কসোভো ও আলবেনিয়ার প্রেসিডেন্ট এবং কসোভোর প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। তারা বাংলাদেশের শ্রমিক গ্রহণে আগ্রহ প্রকাশ করেছেন।
তবে এসব দেশে বাংলাদেশের দূতাবাস না থাকায় ভিসা প্রক্রিয়ায় জটিলতা দেখা দিচ্ছে। প্রেস সচিব বলেন, “অনেক ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের ভিসার আবেদন করতে হয় নয়াদিল্লিতে গিয়ে। প্রধান উপদেষ্টা চান এই জটিলতা দ্রুত দূর করা হোক।”
রেমিট্যান্স প্রবাহে ইতিবাচক প্রভাব
প্রবাসী আয় বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে সবচেয়ে বড় অবদান রাখে। নতুন শ্রমবাজারে প্রবেশ করতে পারলে বছরে অতিরিক্ত তিন থেকে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স আসতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।
অর্থনীতিবিদদের মতে, মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ঐতিহ্যগত বাজারের পাশাপাশি ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশ বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বৈচিত্র্যময় করবে এবং কর্মসংস্থানের নতুন দিগন্ত খুলবে।
শিল্প খাতের চ্যালেঞ্জ ও ব্যবসায়ীদের দাবি
বৈঠকে শিল্পখাতের উদ্যোক্তারা গ্যাস সরবরাহ, ব্যাংক খাতের স্থিতিশীলতা, রপ্তানি প্রণোদনা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন বিষয়ে মত দেন।
তারা বলেন, “ম্যানমেড ফাইবারসহ শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ধারাবাহিক গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা জরুরি। এজন্য রিগ্যাসিফিকেশন ইউনিট সম্প্রসারণ ও নতুন ল্যান্ড বেস টার্মিনাল স্থাপন করা প্রয়োজন।”
বাণিজ্য চুক্তি ও বিদেশি বিনিয়োগ
প্রেস সচিব জানান, মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি (এফটিএ) বিষয়ে বাংলাদেশ বর্তমানে জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও মালয়েশিয়ার সঙ্গে আলোচনা চালাচ্ছে। দরকষাকষির সক্ষমতা বাড়াতে সরকার এডিবি ও বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় কাজ করছে।
প্রযুক্তি ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
আইসিটি খাতকে আরও গতিশীল করতে সরকার কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি নির্ভর শিল্পে প্রণোদনা বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টা বৈঠকে নির্দেশ দেন, “এ খাতে কর্মসংস্থান ও সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য শিগগিরই একটি রোডম্যাপ উপস্থাপন করা হবে।”
অর্থনীতি স্থিতিশীল পথে
সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর দেশের ব্যাংক খাত ও অর্থনৈতিক সূচক তুলে ধরেন। তিনি জানান, “দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ এখন পাঁচ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান। মুদ্রাস্ফীতি ১২ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে কমে ৮ দশমিক ৩ শতাংশে নেমে এসেছে।”
সার্বিক মূল্যায়ন
বিশ্লেষকরা মনে করছেন, প্রধান উপদেষ্টার এই নির্দেশনা সরকারের কূটনৈতিক কার্যক্রমে নতুন গতি আনবে।
ভিসা জটিলতা নিরসন এবং দূতাবাস নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ শুধু শ্রমিকদের জন্য নয়, শিক্ষার্থী, উদ্যোক্তা ও বিনিয়োগকারীদের জন্যও নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিতে পারে।
পাঠকের মন্তব্য