মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতি সব সময়ই রহস্য, ক্ষমতার খেলা ও আন্তর্জাতিক স্বার্থের জটিলতায় আচ্ছন্ন। এর মধ্যে সৌদি আরবের রাজপরিবার এবং শাসনব্যবস্থা সব সময়ই বৈশ্বিক আলোচনার কেন্দ্রে থেকেছে। ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যু, বাদশাহ সালমানের ক্ষমতায় আসা, একাধিক ক্রাউন প্রিন্সের উত্থান-পতন এবং শেষ পর্যন্ত মোহাম্মদ বিন সালমানের (এমবিএস) ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন হওয়া— প্রতিটি অধ্যায় এক একটি রাজনৈতিক নাটক।
বাদশাহ আবদুল্লাহ থেকে সালমানের ক্ষমতায় আরোহন
২০১৫ সালে বাদশাহ আবদুল্লাহর মৃত্যু মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে বড় শূন্যতা তৈরি করে। দীর্ঘদিন সৌদি রাজনীতিতে প্রভাবশালী অবস্থান ধরে রাখা এই শাসকের মৃত্যু ছিল এক যুগের সমাপ্তি। তার স্থলাভিষিক্ত হন সালমান বিন আবদুল আজিজ। তখন সালমানের বয়স ছিল প্রায় ৭৯ বছর এবং তিনি আলঝেইমার্সে ভুগছিলেন বলে জানা যায়। শুরুতে নিজের ছেলেকে নয়, ভাইপো মুকরিন বিন আবদুল আজিজকে ক্রাউন প্রিন্স করেন সালমান। কিন্তু মাত্র কয়েক মাস পর নাটকীয়ভাবে তাকে সরিয়ে দেন।
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হিসেবে এমবিএসের উত্থান
মাত্র ২৯ বছর বয়সে মোহাম্মদ বিন সালমান প্রতিরক্ষামন্ত্রী হয়ে ওঠেন সৌদি রাজনীতির নতুন মুখ। এত অল্প বয়সে প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়া এক বিরল ঘটনা। তিনি ছিলেন প্রাসাদের এক দুষ্টু শিশু, যিনি ইংরেজি ক্লাসে পড়াশোনার চেয়ে নিরাপত্তারক্ষীদের সঙ্গে ওয়াকিটকিতে কথা বলতে বেশি পছন্দ করতেন। তবুও রাজনৈতিক দূরদর্শিতা এবং ক্ষমতা দখলের তীব্র ইচ্ছাশক্তি তাকে দ্রুত শীর্ষে নিয়ে আসে।
ইয়েমেন যুদ্ধ: জনপ্রিয়তা থেকে সমালোচনা
প্রতিরক্ষামন্ত্রী হওয়ার পরই এমবিএস ইয়েমেনে হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে বিমান হামলার নির্দেশ দেন। প্রথমদিকে সৌদি জনগণ ও আন্তর্জাতিক মহল একে ইরানের প্রভাব মোকাবিলার সাহসী পদক্ষেপ মনে করেছিল। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই এই যুদ্ধ মানবিক বিপর্যয় ডেকে আনে। লাখো মানুষ বাস্তুচ্যুত হন, হাজারো মানুষ প্রাণ হারান। আন্তর্জাতিক মহলে যুদ্ধকে “মোহাম্মদ বিন সালমানের পররাষ্ট্রনীতির ব্যর্থতা” হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়।
যুবরাজ নায়েফকে সরানো
২০১৭ সালে রাজপরিবারের অভ্যন্তরীণ এক বৈঠকে যুবরাজ মোহাম্মদ বিন নায়েফকে নাটকীয়ভাবে সরিয়ে দেওয়া হয়। তাকে গৃহবন্দি করা হয় এবং পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষরে বাধ্য করা হয়। তার স্বাস্থ্য সমস্যা, নেশাজাতীয় ওষুধের আসক্তি— এগুলোকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করা হলেও আসল উদ্দেশ্য ছিল এমবিএসকে ক্রাউন প্রিন্স বানানো। ৩৪ সদস্যের মধ্যে ৩১ জন রাজপরিবারের সদস্য এ সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। এভাবেই শুরু হয় এমবিএসের প্রকৃত ক্ষমতার যাত্রা।
সংস্কারের আড়ালে নিয়ন্ত্রণ
মোহাম্মদ বিন সালমান যুব সমাজ ও নারীদের কাছে আধুনিকতার প্রতীক হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন করেন। নারীদের গাড়ি চালানোর অধিকার দেন, পোশাক বিধি শিথিল করেন, এমনকি পশ্চিমা ধাঁচে বিনোদনের সুযোগ বাড়ান। কিন্তু সমালোচকরা মনে করেন, এগুলো ছিল অর্থনৈতিক কৌশল, প্রকৃত স্বাধীনতা নয়। একই সময়ে ভিন্নমতাবলম্বীদের দমন করা হয়, হাজার হাজার মানুষ বিনা বিচারে আটক থাকেন, সাংবাদিকরা কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন।
বিলাসবহুল জীবনের বিতর্ক
এমবিএসের ব্যক্তিগত জীবনও বিশ্বব্যাপী আলোচনার বিষয়। তিনি ৪৪০ ফুট লম্বা ইয়ট কিনতে ৫০০ মিলিয়ন ডলার খরচ করেন, দা ভিঞ্চির একটি চিত্রকর্ম কিনতে ব্যয় করেন ৪৫০ মিলিয়ন ডলার। সমালোচকরা বলেন, একদিকে তিনি দুর্নীতি দমন অভিযান চালান, অন্যদিকে নিজেই বিলাসিতায় নিমজ্জিত।
দুর্নীতি বিরোধী অভিযান
২০১৭ সালে ৩৮০ জন প্রিন্স, ব্যবসায়ী ও সরকারি কর্মকর্তাকে রিটজ-কার্লটন হোটেলে বন্দি করে রাখা হয়। অভিযোগ ছিল সরকারি তহবিল তছরুপ। তাদের অনেকে কোটি কোটি ডলার ফেরত দেওয়ার পর মুক্তি পান। সমালোচকদের মতে, এটি ছিল রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের দুর্বল করার কৌশল।
সাংবাদিক জামাল খাসোগজি হত্যা
২০১৮ সালে তুরস্কে সৌদি কনস্যুলেটের ভেতরে সাংবাদিক জামাল খাসোগজিকে হত্যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ঝড় তোলে। সিআইএ’র তদন্তে উঠে আসে, হত্যার নির্দেশ দেন এমবিএস। যদিও তিনি অস্বীকার করেন, তবে হত্যার দায়ভার নিজের কাঁধে নেন। ঘটনাটি সৌদি সরকারের মানবাধিকার চিত্রকে গভীর সংকটে ফেলে দেয়।
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া
হিউম্যান রাইটস ওয়াচ জানায়, সৌদিতে হাজার হাজার মানুষ বিচার ছাড়াই আটক আছেন। ২৬ জন সাংবাদিক কারাগারে, যা বিশ্বে তৃতীয় সর্বোচ্চ। ২০১৯ সালে এক হাজার সৌদি নাগরিককে ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় রাখা হয়। এসব ঘটনায় আন্তর্জাতিক মহলে সৌদি আরবের ভাবমূর্তি প্রশ্নবিদ্ধ হয়।
উপসংহার
আজ সৌদি আরবের প্রতিটি মোড়ে মোহাম্মদ বিন সালমানের পোস্টার শোভা পাচ্ছে। তিনি আধুনিকতার স্বপ্ন দেখালেও তার শাসনব্যবস্থা মানবাধিকার লঙ্ঘন, দমন-পীড়ন ও বিলাসিতার জন্য সমালোচিত। তিনি কি সত্যিই সংস্কারক, নাকি নতুন এক স্বৈরশাসক— এ প্রশ্ন এখন বিশ্ব রাজনীতির অঙ্গনে জ্বলজ্বল করছে।
পাঠকের মন্তব্য