রংপুরের পীরগাছা উপজেলায় এখন বিরল রোগের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। গবাদি পশু থেকে মানুষের মধ্যে সংক্রমিত মারাত্মক এই রোগের কারণে স্থানীয় জনগণের মধ্যে ভয় ও উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে। দুই শতাধিক মানুষ আক্রান্ত হয়েছেন, এবং শঙ্কা রয়েছে যে যদি দ্রুত ব্যবস্থা না নেওয়া হয়, তবে এটি মহামারিতে রূপ নিতে পারে। তবে, বিশেষজ্ঞদের মতে, এই পরিস্থিতির জন্য মূলত দায়ী স্বাস্থ্য বিভাগ ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অবহেলা।
অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গের মিল:
স্থানীয় স্বাস্থ্যকর্মীরা দাবি করছেন যে এই রোগের উপসর্গ অ্যানথ্রাক্সের সঙ্গে একেবারে মিলে যাচ্ছে। শরীরে প্রথমে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, তারপর তা ঘা-তে পরিণত হয় এবং শেষ পর্যন্ত গভীর ক্ষত তৈরি হয়। অসুস্থ গবাদি পশুর সেবা করতে গিয়ে বা তাদের মাংস স্পর্শ করে অনেকেই আক্রান্ত হচ্ছেন। বেশ কিছু পরিবার একসঙ্গে আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে, কিন্তু এখনো পর্যন্ত স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে কোনো কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
স্থানীয় বাসিন্দাদের অভিযোগ:
অনন্তরাম বড়বাড়ি এলাকার বাসিন্দা সাবিনা আক্তার বলেন, “একটি গরু ও ছাগল অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়ার পর, তাদের সেবা করতে গিয়ে আমি আক্রান্ত হই। প্রথমে হাতের ফুসকুড়ি দেখা দেয়, পরে তা বড় ঘায়ে পরিণত হয়। এখনো চিকিৎসা নিচ্ছি, তবে কোনো সরকারি সহায়তা পাচ্ছি না।”
এছাড়া, জাহেদা বেগম, একজন ৫০ বছরের বৃদ্ধা, জানান, “আমার হাতের আঙ্গুলে প্রথম চুলকানি শুরু হয়, তারপর তা বড় হয়ে ঘা-তে পরিণত হয়। স্থানীয় চিকিৎসক বলেছেন, এটি অ্যানথ্রাক্স হতে পারে, তবে স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে কোনো পরীক্ষা হয়নি।”
স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের অবহেলা:
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তারা এ বিষয়ে উদাসীন। খামারিরা অসুস্থ পশু বিক্রি করে দিচ্ছেন, যার মাধ্যমে রোগটি আরও ছড়িয়ে পড়ছে। অনেক সময় প্রাণিসম্পদ বিভাগের কোনো কর্মকর্তার দেখা পাওয়া যায় না, যার কারণে আক্রান্ত পশুর সঠিক চিকিৎসা বা প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণ করা সম্ভব হচ্ছে না।
পীরগাছা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপ-সহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার আঁখি সরকার বলেন, “প্রতিদিন ৫ থেকে ৭ জন রোগী স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসছেন। কিছু পরিবারের সব সদস্যও আক্রান্ত হচ্ছেন। তবে এখনো পর্যন্ত পরীক্ষা করা হয়নি, কিন্তু এটি অ্যানথ্রাক্সের উপসর্গের সঙ্গে মিলে যাচ্ছে।”
রংপুর জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আবু ছাঈদ বলেন, “এটি একটি ‘জেনেটিক ডিজিজ’। এখানে মূল সমস্যা হয়েছে স্বাস্থ্য বিভাগের অবহেলা।”
এটি কি মহামারি হতে পারে?
বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি দ্রুত রোগটির শনাক্তকরণ এবং প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করা হয়, তবে এটি আরও বড় মহামারির আকার ধারণ করতে পারে। জনস্বাস্থ্য অধিকার আন্দোলনের সভাপতি বেলাল হোসেন বলেন, “যদি দ্রুত শনাক্ত করা না যায় এবং কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া না হয়, তাহলে এটি পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়তে পারে।”
প্রশাসনিক পদক্ষেপ:
রংপুর জেলা প্রশাসক রবিউল ফয়সাল জানিয়েছেন, “আমি ইতিমধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের সাথে যোগাযোগ করেছি এবং উপজেলা নির্বাহী অফিসারকে বিষয়টি তদারকি করার নির্দেশ দিয়েছি।”
অপেক্ষা করে থাকা নয়, এখনই পদক্ষেপ নিতে হবে:
এই মুহূর্তে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো রোগটির সঠিক শনাক্তকরণ এবং দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ। স্বাস্থ্য বিভাগের উচিত মাঠ পর্যায়ে দ্রুত মেডিকেল টিম গঠন করা এবং আক্রান্ত এলাকায় যথাযথ চিকিৎসা প্রদান করা। একইভাবে প্রাণিসম্পদ বিভাগকে মাঠে নামিয়ে গবাদি পশুর চিকিৎসা এবং প্রতিরোধ কার্যক্রম চালু করতে হবে।
উপসংহার:
পীরগাছার মানুষের জন্য এই পরিস্থিতি সত্যিই আতঙ্কের। একদিকে গবাদি পশু থেকে মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ছে বিরল রোগ, অন্যদিকে সরকারি দপ্তরগুলির অবহেলা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলছে। দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে এটি একটি বড় জনস্বাস্থ্য সংকটে পরিণত হতে পারে। তাই স্থানীয় প্রশাসন, স্বাস্থ্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
পাঠকের মন্তব্য