রাশিয়া ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে কৌশলী অবস্থান বজায় রাখছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। একদিকে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রেখেছেন, অন্যদিকে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ব্যাপারে নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করছেন। তবে ভারতের এই দ্বিমুখী অবস্থান পশ্চিমাদের জন্য হতাশাজনক।
যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় দেশগুলো রাশিয়ার ওপর একের পর এক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলেও, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত রাশিয়ার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখায় এসব নিষেধাজ্ঞা অনেকটাই কার্যকারিতা হারিয়েছে—এমনটাই মনে করেন পশ্চিমা নেতারা। আর এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করেই ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প।
ট্রাম্পের কড়া বার্তা
রাশিয়া থেকে ভারতের জ্বালানি তেল আমদানি ট্রাম্প প্রশাসনের প্রধান আপত্তির বিষয়। তাঁর ভাষ্য অনুযায়ী, ভারত শুধু বিপুল পরিমাণে রুশ তেল আমদানিই করছে না, বরং সেই তেল পরিশোধন করে বিশ্ববাজারে বিক্রি করেও বিপুল মুনাফা করছে। ইউক্রেন যুদ্ধে যে অস্ত্র ব্যবহার হচ্ছে, তা কিনতে রাশিয়াকে এই তেলের অর্থ সাহায্য করছে বলেও অভিযোগ করেছেন ট্রাম্প।
এমন পরিস্থিতিতে গত বুধবার ট্রাম্প প্রশাসন ভারতীয় পণ্যের ওপর অতিরিক্ত ২৫ শতাংশ শুল্ক আরোপ করে, যা আগামী ২১ দিনের মধ্যে কার্যকর হবে। এর আগেই ২৫ শতাংশ পাল্টা শুল্ক আরোপ করা হয়েছিল, ফলে মোট শুল্ক দাঁড়াচ্ছে ৫০ শতাংশে।
নয়াদিল্লির প্রতিক্রিয়া
ভারত এই শুল্ককে ‘অন্যায্য, অযৌক্তিক ও অগ্রহণযোগ্য’ বলে অভিহিত করেছে। ভারতের দাবি, যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলো এখনো রাশিয়া থেকে সার, রাসায়নিক ও অন্যান্য পণ্য কিনছে। সুতরাং শুধু ভারতের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা দ্বিমুখী নীতি।
রুশ তেলের প্রতি ভারতের নির্ভরশীলতা
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ব্যাখ্যায় বলা হয়, ১৪০ কোটিরও বেশি জনসংখ্যার দেশের জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাশিয়া থেকে অপরিশোধিত তেল আমদানি অর্থনৈতিক বাস্তবতা।
বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম তেল আমদানিকারক দেশ ভারত। গবেষণা প্রতিষ্ঠান কেপলারের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে ভারতের মোট তেল আমদানির ৩৬ শতাংশ এসেছে রাশিয়া থেকে।
‘রাতারাতি রুশ তেল ছাড়ার উপায় নেই‘
জওহরলাল নেহরু বিশ্ববিদ্যালয়ের সহযোগী অধ্যাপক অমিতাভ সিং জানান, রাশিয়া পশ্চিমাদের নিষেধাজ্ঞার পর বড় ছাড়ে তেল দিচ্ছে—এ সুযোগ ভারতের অর্থনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোই যৌক্তিক। তবে ইউক্রেনের মিত্র দেশগুলো একে নৈতিক ব্যর্থতা হিসেবে দেখছে।
তিনি বলেন, ‘রুশ তেলের বাজার থেকে রাতারাতি বেরিয়ে আসা সম্ভব নয়। এমনকি যদি মোদি সরকার মধ্যপ্রাচ্য থেকে তেল আমদানি বাড়াতে চায়, তাহলেও তাৎক্ষণিকভাবে সেই শূন্যতা পূরণ করা কঠিন।’
বৈশ্বিক প্রভাব
ভারত সরকারের দাবি, তারা রাশিয়া থেকে তেল কিনে বিশ্ববাজারে তেলের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করছে, কারণ এতে তারা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক তেলের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নামছে না।
ভারত রাশিয়ার অপরিশোধিত তেল পরিশোধন করে ইউরোপ, যুক্তরাজ্য এবং যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি করে। এতে সেসব দেশও পরোক্ষভাবে রুশ জ্বালানি ব্যবস্থার সুবিধাভোগী।
ঐতিহাসিক মিত্রতা ও কূটনৈতিক ভারসাম্য
ভারত ও রাশিয়ার সম্পর্ক বহু দশকের। স্নায়ুযুদ্ধকালীন সময়ে ভারত নিরপেক্ষ থাকলেও বাস্তবে সোভিয়েত ইউনিয়নের দিকে ঝুঁকে ছিল। পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক সহায়তার জবাবে ভারত রাশিয়ার কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ শুরু করে।
বর্তমানে যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইসরায়েল থেকেও ভারত অস্ত্র কিনছে, তবু রাশিয়ার সবচেয়ে বড় অস্ত্র ক্রেতা ভারতই। মোদির সঙ্গে যেমন ট্রাম্পের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে, তেমনি পুতিনের সঙ্গেও রয়েছে বিশেষ কূটনৈতিক সখ্যতা।
সম্পর্কের টানাপোড়েন
২০১৯ সালে এক জনসভায় ট্রাম্প বলেছিলেন, “প্রেসিডেন্ট হিসেবে এমন বন্ধু ভারতের আর কখনো ছিল না।” কিন্তু দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন সেই সম্পর্কেই দেখা যাচ্ছে ফাটল।
একদিকে ট্রাম্প ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বন্ধের প্রতিশ্রুতি দিয়ে এখনও সাফল্য দেখাতে পারেননি, অন্যদিকে ভারতের রুশ তেল আমদানিকে তিনি যুদ্ধকে দীর্ঘায়িত করার কারণ হিসেবে দোষারোপ করছেন।
সাম্প্রতিক এক পোস্টে ট্রাম্প লেখেন, ‘ভারত রাশিয়ার সঙ্গে কী করছে, তা আমি পরোয়া করি না। তারা চাইলে একসঙ্গে তাদের মৃতপ্রায় অর্থনীতিকে ধ্বংস করতে পারে।’
পাঠকের মন্তব্য