গত বছর ফ্যাসিবাদী শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করলে এক বছরের মধ্যেই দেশের অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। বিশেষত দ্রব্যমূল্যের বাজারে উল্লেখযোগ্য রূপান্তর ঘটে। বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি অনেকটাই স্থিতিশীল, এবং ব্যবসা পরিচালনায় সহজতর পরিবেশ গড়ে তুলতে একাধিক সংস্কারমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের দক্ষ ও বিচক্ষণ নেতৃত্বের ফলে গত এক বছরে বাজারে স্থিতিশীলতা দৃশ্যমান হয়, বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর দুই প্রধান ধর্মীয় উৎসব—পবিত্র ঈদুল ফিতর ও ঈদুল আজহার সময়। এ সময় বাজারে নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে ছিল, যা পূর্ববর্তী সরকারের সময় বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নেতৃত্বে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থা কঠোর মনিটরিং চালিয়ে গেছে। বাজারে পর্যাপ্ত পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করাসহ চাঁদাবাজি রোধে নেওয়া কার্যকর পদক্ষেপগুলোর কারণে এই স্থিতিশীলতা সম্ভব হয়েছে। জাতীয় বার্তা সংস্থা বাসসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান জানান, গত বছরের তুলনায় বর্তমানে বাজার পরিস্থিতি অনেক উন্নত। গত ১২ মাস ধরে বাজারে বড় ধরনের অস্থিরতা দেখা যায়নি, এবং জনগণের মধ্যে আর আগের মতো উদ্বেগ নেই।
সচিব আরও বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে এবং ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)-এর কার্যক্রম আরও বিস্তৃত করা হবে। এ ছাড়া, তিনি জানান, উৎসবের সময় কিংবা রমজান মাসে চাহিদা বেড়ে গেলে কিছুটা অস্থিরতা তৈরি হয়, তবে এবার সরকার প্রস্তুত ছিল। গত বছরের তুলনায় এ বছর প্রায় দ্বিগুণ সংখ্যক, অর্থাৎ ২৮টি দল মাঠে কাজ করেছে এবং বিভাগীয় পর্যায় ছাড়িয়ে জেলা-উপজেলা পর্যায়েও বাজার তদারকি কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে।
সচিব জানান, রমজান ও ঈদের সময় চাহিদার তুলনায় সরবরাহ ভালো ছিল এবং কঠোর মনিটরিংয়ের কারণে বাজারে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা সম্ভব হয়েছে। এ বছর চার শতাধিক দল সার্বক্ষণিকভাবে মাঠে সক্রিয় ছিল, যার ফলে মূল্যবৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে রাখা সহজ হয়েছে। যদিও জুন-জুলাইয়ের দিকে চালের বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিয়েছিল, তবে পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে যায়।
টিসিবির কার্যক্রম প্রসঙ্গে সচিব বলেন, বর্তমানে প্রায় এক কোটি পরিবারের জন্য পারিবারিক কার্ডের আওতায় ভর্তুকিযুক্ত পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে। তবে সব উপকারভোগীর কাছে স্মার্টফোন না থাকায় স্মার্ট কার্ড ব্যবহারে কিছু সমস্যা হচ্ছে, যা জেলা প্রশাসনের সহায়তায় সমাধান করা হচ্ছে। স্বল্প আয়ের মানুষের জন্য ‘ট্রাক সেল’ কার্যক্রমও চালু রয়েছে।
বাণিজ্য ও ব্যবসায়িক পরিবেশে সরকারের নেওয়া সংস্কার উদ্যোগের মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ‘ইজি অব ডুয়িং বিজনেস’ – অর্থাৎ ব্যবসা পরিচালনার প্রক্রিয়া সহজীকরণ। এ লক্ষ্যে আমদানি নীতিতে সংশোধন আনা হচ্ছে যাতে সনদ ও অনুমোদন প্রক্রিয়া সরল হয়। বাণিজ্য সচিব জানান, সরকার একটি বাণিজ্য আদালত প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে নীতিগত সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে গ্রহণ করা হয়েছে এবং খসড়া আইন প্রণয়ন করে মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করা হবে। প্রাথমিকভাবে এসব আদালত ঢাকা ও বিভাগীয় শহরে চালু হবে এবং পরবর্তীতে প্রয়োজন হলে তা সম্প্রসারিত হবে।
দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি নিয়েও অগ্রগতি হয়েছে বলে সচিব জানান। এরই মধ্যে ভুটানের সঙ্গে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। জাপানের সঙ্গে ইকোনমিক পার্টনারশিপ অ্যাগ্রিমেন্ট (EPA) নিয়ে সপ্তম দফার আলোচনা আগস্টে শুরু হবে, এবং ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে আলোচনা পুনরায় চালু হচ্ছে। একইসঙ্গে সংযুক্ত আরব আমিরাত, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, নাইজেরিয়া ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি বিষয়েও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
বিশ্ববাজারে কিছু চ্যালেঞ্জ থাকা সত্ত্বেও দেশের রপ্তানি আয় বাড়ছে এবং পণ্যের বৈচিত্র্যকরণে অগ্রগতি হচ্ছে বলে সচিব দাবি করেন। তিনি জানান, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে শুল্ক বিষয়ক আলোচনা সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে, যেখানে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন।
খুচরা ও পাইকারি দামের ব্যবধান প্রসঙ্গে সচিব বলেন, ইতোমধ্যে সরকার এই বিষয়ে কিছু অগ্রগতি করেছে। খাদ্য ও কৃষি মন্ত্রণালয় এবং প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সঙ্গে একাধিক বৈঠকের মাধ্যমে চাঁদাবাজি হ্রাসে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।
এফবিসিসিআইয়ের প্রশাসক মো. হাফিজুর রহমান বলেন, ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাজারে কিছুটা অস্থিরতা দেখা দিলেও, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, এফবিসিসিআই এবং ব্যবসায়ী নেতাদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় পরিস্থিতি দ্রুত স্থিতিশীল হয়। তবে ডিম, তেল ও মুরগির মতো নিত্যপণ্যের ক্ষেত্রে এখনও কিছু সমস্যা রয়েছে, যা আবহাওয়া ও সরবরাহ-নির্ভর।
গত এক বছরের মূল্যস্ফীতির প্রবণতাও এই স্থিতিশীলতার প্রমাণ দেয়। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের জুলাইয়ে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতির হার ছিল ১১.৬৬ শতাংশ, যা ছিল ১২ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি ছিল ১৪.১০ শতাংশ এবং অখাদ্যপণ্যের ক্ষেত্রে তা ছিল ৯.৬৮ শতাংশ। তবে ২০২৫ সালের জুন মাসে খাদ্যসামগ্রীর মূল্যস্ফীতি কমে ৭.৩৯ শতাংশে নেমে আসে, যা গত দুই বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। একই সময়ে অখাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতিও কমে ৯.৩৭ শতাংশে দাঁড়ায়। এই প্রবণতা শহর ও গ্রাম উভয় অঞ্চলে দৃশ্যমান ছিল।
পাঠকের মন্তব্য