জুলাই গণঅভ্যুত্থানের উত্তাল পটভূমিতে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ড ঘোষণার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে দীর্ঘদিনের স্বৈরশাসন ও নিপীড়নের বিচারিক অধ্যায়ের এক গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক স্থাপিত হয়েছে।
এই রায়ের মাধ্যমে আদালত শুধু ব্যক্তির অপরাধের বিচার করেনি—বরং মানুষের ন্যায্য প্রতিরোধ, গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষা এবং দীর্ঘদিনের রাষ্ট্রীয় দমনপীড়নের বিরুদ্ধে জনগণের ঐতিহাসিক সংগ্রামের প্রতিধ্বনি তুলে ধরেছে। শহীদ পরিবার, নিখোঁজ ব্যক্তিদের স্বজন এবং নির্যাতিত মানুষের চোখে আজ অশ্রুর সঙ্গে ফিরে এসেছে শোকের ন্যূনতম প্রতিকার।
তবে রায় ঘোষণার পর উদ্দীপনা ও আবেগের মধ্যেও জাতীয় পরিসরে শান্তি বজায় রাখতে কঠোর বার্তা দিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার।
অন্তর্বর্তী সরকারের বিবৃতি: “শান্ত থাকুন, দায়িত্বশীল থাকুন”
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকে পাঠানো এক জরুরি বিবৃতিতে বলা হয়েছে—
“মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড একটি ঐতিহাসিক রায়। এই রায়ের গভীর তাৎপর্য উপলব্ধি করে সর্বস্তরের জনগণকে শান্ত, সংযত ও দায়িত্বশীল থাকার আহ্বান জানানো হচ্ছে।”
বিবৃতিতে আরও বলা হয়—
“রায়-পরবর্তী সময়ে কোনো ধরনের উচ্ছৃঙ্খলতা, উত্তেজনাপ্রসূত আচরণ বা আইনবিরোধী কর্মকাণ্ড থেকে সবাইকে বিরত থাকতে হবে। আবেগের বশবর্তী হয়ে যেন কেউ জনশৃঙ্খলা বিঘ্নিত না করে—সরকার এ বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করেছে।”
জুলাই গণঅভ্যুত্থানে নিহতদের পরিবার বহু বছর ধরে ন্যায়বিচারের অপেক্ষায় ছিলেন। এই রায় তাদের কাছে এক নৈতিক স্বস্তি ও ন্যায়বিচারের প্রতীক। কিন্তু সরকার মনে করিয়ে দিয়েছে—
“আবেগ থাকলেও আইনশৃঙ্খলা ভঙ্গের কোনো সুযোগ নেই।”
বিবৃতিতে আরও যোগ করা হয়—
“জনশৃঙ্খলা ভঙ্গের যে কোনো চেষ্টা কঠোরভাবে দমন করা হবে। অরাজকতার কোনো সুযোগ দেওয়া হবে না।”
গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট: দীর্ঘশ্বাস থেকে প্রতিবাদের জন্ম
জুলাই গণঅভ্যুত্থান ছিল সাধারণ মানুষের হৃদয়ের প্রতিক্রিয়া—
-
বছরের পর বছর গুম-খুনের ভীতি,
-
রাষ্ট্রীয় বাহিনীর অপব্যবহার,
-
গণমাধ্যমের দমন,
-
মানবাধিকার লঙ্ঘন,
-
আরোপিত নির্বাচন ও গণতন্ত্রহীনতার বেদনা মানুষের মধ্যে积 হয়ে ছিল।
রক্তে রঞ্জিত সেই দিনগুলোতে প্রাণ হারান বহু তরুণ, নারী, শ্রমিক ও সাধারণ নাগরিক। আজকের রায় তাই শুধু অভিযুক্তদের বিচার নয়—এটি সেই শহীদদের প্রতি রাষ্ট্রের নৈতিক প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন।
ন্যায়বিচারের নতুন অধ্যায়
বিচারপতি মো. গোলাম মর্তূজা মজুমদারের নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-১ যে রায় ঘোষণা করেছে, তা দেশের ইতিহাসে নজিরবিহীন।
– শেখ হাসিনাকে তিনটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড,
– দুটি অভিযোগে আমৃত্যু কারাদণ্ড,
– সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কামালকে মৃত্যুদণ্ড,
– সাবেক আইজিপি চৌধুরী আব্দুল্লাহ আল-মামুনকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
এই রায় বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থার সক্ষমতা, রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে মানবিক মূল্যবোধের প্রতি অঙ্গীকার এবং জনগণের ন্যায্য দাবি প্রতিফলনের এক গভীর উদাহরণ।
নতুন দায়িত্ব—শান্তি, সতর্কতা ও মানবিক ঐক্য
যে উত্তাল ইতিহাস পেরিয়ে আজ বাংলাদেশ নতুন অধ্যায়ে দাঁড়িয়ে, সেখানে উচ্ছ্বাসের সঙ্গে দায়িত্ববোধ হাত ধরাধরি করেই এগোতে হবে।
রায়কে ঘিরে যেন আনন্দ-উল্লাস বা প্রতিশোধপরায়ণতার প্রকাশ না ঘটে—এ নিয়ে সরকার যেমন সতর্ক, তেমনি মানবাধিকার সংস্থা ও নাগরিক সংগঠনগুলিও শান্ত থাকার আহ্বান জানিয়েছে।
একটি জাতির পুনর্গঠনের পথে সবচেয়ে প্রয়োজন—সংযম, আইনের প্রতি আস্থা এবং মানবতার সম্মিলন।
বাংলাদেশ আজ সেই চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি।
মানুষের প্রত্যাশা
যারা প্রিয়জন হারিয়েছেন, যারা সহিংসতার শিকার হয়েছেন, যারা অপমানিত ও ভয়গ্রস্ত ছিলেন—তারা আজ স্বস্তি পেলেও, তাদের চোখে আরও একটি দাবি—
পাঠকের মন্তব্য