বাংলাদেশ সফররত পাকিস্তানের যৌথ বাহিনীর চেয়ারম্যান জেনারেল সাহির শামশাদ মির্জার সঙ্গে সাক্ষাৎকালে একটি ছবিকে ঘিরে ভারতীয় গণমাধ্যমে বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। সেই ছবিতে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি উপহার তুলে দিতে দেখা যায়, যা নিয়ে ইন্ডিয়া টুডে, আনন্দবাজার, হিন্দুস্তান টাইমসসহ বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম দাবি করেছে—
‘উপহারের মানচিত্রে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলের অংশকে বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্ত করে দেখানো হয়েছে।’
তবে মঙ্গলবার (২৮ অক্টোবর) প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের প্রেস উইং এক বিবৃতিতে এ দাবিকে “সম্পূর্ণ অসত্য ও কল্পনাপ্রসূত” বলে প্রত্যাখ্যান করেছে।
উপহারের বই: ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’
বিবৃতিতে বলা হয়, অধ্যাপক ইউনূস পাকিস্তানের জেনারেল মির্জাকে উপহার দিয়েছেন ‘দ্য আর্ট অব ট্রায়াম্ফ’, যা মূলত ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সময় শিক্ষার্থীদের আঁকা গ্রাফিতি চিত্রের সংকলন।
এই বইয়ে গণআন্দোলনের সময়কার ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ ও বিপ্লবের চিত্র প্রতিফলিত হয়েছে।
বইটির প্রচ্ছদে ‘জুলাই বিপ্লবের শহীদ আবু সাইদের পিছনে রক্তরাঙা বাংলাদেশের মানচিত্র’ ব্যবহার করা হয়েছে।
প্রেস উইংয়ের ভাষ্য—
“মানচিত্রটি যেহেতু একটি গ্রাফিতি, তাই বাস্তব মানচিত্রের সঙ্গে কিছুটা শৈল্পিক পার্থক্য রয়েছে। এতে ভারতের কোনো অংশ যুক্ত করা হয়নি।”
বিতর্কের সূত্রপাত
শনিবার (২৬ অক্টোবর) রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ইউনূস ও জেনারেল মির্জার সাক্ষাৎ হয়।
সাক্ষাতে তারা বাংলাদেশ-পাকিস্তান সম্পর্ক, বাণিজ্য ও প্রতিরক্ষা সহযোগিতাসহ বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করেন।
সাক্ষাতের চারটি ছবি পরদিন প্রধান উপদেষ্টার অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে প্রকাশ করা হয়।
তাদের একটি ছবিতে দেখা যায়, অধ্যাপক ইউনূস জেনারেল মির্জার হাতে বইটি দিচ্ছেন—এই ছবিটিই পরবর্তীতে ভারতীয় গণমাধ্যমে ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে প্রকাশ করা হয়।
ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন
‘ইন্ডিয়া টুডে’, ‘দ্য প্রিন্ট’, ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’, ‘দ্য হিন্দু’সহ বিভিন্ন ভারতীয় গণমাধ্যমে দাবি করা হয়—
বইটির প্রচ্ছদে ভারতের উত্তর–পূর্বাঞ্চলকে বাংলাদেশের মানচিত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
আনন্দবাজার প্রশ্ন তোলে—
“বাংলাদেশ কি ফের ভারতীয় ভূখণ্ড নিজেদের দিকে টেনে দেখাতে চাইল?”
তবে ভারত সরকার বা নয়াদিল্লি এ নিয়ে কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
তথ্য যাচাই ও সরকারি প্রতিক্রিয়া
প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইংয়ের ফ্যাক্ট-চেক প্ল্যাটফর্ম ‘CA Press Wing Facts’ ফেসবুক পেজে সোমবার রাতে দুইটি পোস্টে বলা হয়—
“ইন্ডিয়া টুডে ও অন্যান্য গণমাধ্যমের দাবি ভিত্তিহীন। গ্রাফিতি মানচিত্রটি বাংলাদেশের আসল ভূচিত্রের সৃজনশীল রূপ, কোনো ভূখণ্ড বাড়ানো হয়নি।”
বিবৃতিতে আরও জানানো হয়,
“এই একই বই অধ্যাপক ইউনূস এর আগে জাতিসংঘ মহাসচিব, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডোকেও উপহার দিয়েছেন।”
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রতিক্রিয়া
ভারতীয় গণমাধ্যমে খবর প্রকাশের পর বাংলাদেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও বিষয়টি ব্যাপক আলোচনায় আসে।
অনেকে ভারতীয় সংবাদমাধ্যমের ‘অতিরঞ্জিত ব্যাখ্যা’ ও ‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত খবর’ বলে সমালোচনা করেন।
বিশ্লেষণ
বাংলাদেশ সরকার শুরু থেকেই স্পষ্ট করেছে—
এই বিতর্কের কোনো বাস্তব ভিত্তি নেই, এটি একটি শৈল্পিক গ্রাফিতিকে বিকৃতভাবে উপস্থাপনের ফল।
প্রেস উইংয়ের বিবৃতির ভাষায়,
“একটি শিল্পকর্মের মানচিত্রকে ভূরাজনৈতিক মানচিত্র হিসেবে ব্যাখ্যা করা উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও বিভ্রান্তিকর।”
পাঠকের মন্তব্য