সরকারের প্রশাসনিক মহলে এখন সবচেয়ে আলোচিত প্রশ্ন— কে হচ্ছেন নতুন জনপ্রশাসন সচিব?
সরকারের সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ এই পদটি ১৬ দিন ধরে শূন্য, যা গত দুই দশকে আর কখনো দেখা যায়নি। ফলে সচিবালয়ের করিডোরজুড়ে এখন কৌতূহল, অপেক্ষা এবং সমালোচনার মিশ্র সুর।
জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে রাষ্ট্রযন্ত্রের ‘লাইফলাইন’ হিসেবে দেখা হয়। মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা নিয়োগ থেকে শুরু করে প্রশাসনিক নীতি–নির্ধারণ—সবকিছুই এই মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে।
২১ সেপ্টেম্বর সিনিয়র সচিব ড. মোখলেস উর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার পর থেকে মন্ত্রণালয় কার্যত গতিহীন।
প্রশাসনে উদ্বেগ ও অনিশ্চয়তা
সরকারের একাধিক সিনিয়র কর্মকর্তা বলছেন, জনপ্রশাসন সচিব পদটি খালি থাকায় মাঠপর্যায়ে প্রশাসনিক কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে।
নির্বাচন সামনে রেখে যে সময় মাঠ কর্মকর্তাদের বাছাই, পদায়ন ও নীতিগত সমন্বয়ে ব্যস্ত থাকার কথা—সেই সময়ে মন্ত্রণালয় নিজেই দিকনির্দেশনাহীন অবস্থায় আছে।
একজন কর্মকর্তার ভাষায়,
“জনপ্রশাসন সচিব পদে যত দেরি হচ্ছে, ততটাই প্রশাসনের মনোবল ও দিকনির্দেশনা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।”
চুক্তিভিত্তিকদের মধ্যে আলোচনায় দুই নাম
সরকারের একাধিক সূত্র জানাচ্ছে, চুক্তিভিত্তিক সচিবদের মধ্য থেকে দুজনকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করা হচ্ছে—
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. নাসিমুল গণি এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব এএসএম সালেহ আহমেদ।
ভূমি সচিব সালেহ আহমেদ আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এপিডি উইংয়ে তিন বছরেরও বেশি সময় কাজ করেছেন।
তার অভিজ্ঞতা ও গ্রহণযোগ্যতার কারণে প্রশাসনের ভেতরে অনেকেই তাকে “যোগ্য ও পরীক্ষিত” প্রার্থী হিসেবে দেখছেন।
তবে রাজনৈতিক কারণে তার নিয়োগে আপত্তি রয়েছে একটি প্রভাবশালী দলের, যার ফলে স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণির নামও এখন আলোচনায় উঠে এসেছে।
ড. নাসিমুল গণি এ বিষয়ে বলেন,
“এ ধরনের কোনো আলোচনা আমার জানা নেই। আপনার কাছ থেকেই প্রথম শুনলাম।”
অন্যদিকে ভূমি সচিব সালেহ আহমেদ বলেন,
“কে কোথায় দায়িত্ব পাবেন, সেটা সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্ত। সরকার যেখানে দায়িত্ব দেবে, সেখানেই কাজ করব।”
নিয়মিত কর্মকর্তাদের মধ্যে সম্ভাবনা
নিয়মিত ক্যাডার কর্মকর্তাদের মধ্যেও চলছে তুমুল আলোচনার ঝড়।
১০ম ব্যাচের চারজন সচিবের মধ্যে একজন নারী সচিব রয়েছেন, যিনি সরকারের নিকট আস্থাভাজন হিসেবে বিবেচিত।
তিনি নিয়োগ পেলে প্রথমবারের মতো জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় একজন নারী সচিব পাবে—যা প্রশাসনের ইতিহাসে নতুন দিগন্ত খুলবে।
এ ছাড়া ১১তম ও ১৩তম ব্যাচের কয়েকজন সচিবকেও বিবেচনায় রেখেছে সরকার।
বিশেষ করে সাত নম্বর ভবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের সচিব এবং সচিবালয়ের বাইরের একটি মন্ত্রণালয়ের সচিবের নাম এখন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরে আলোচ্য তালিকায় আছে।
বিলম্বের কারণ কী?
প্রশাসনের অভ্যন্তরীণ সূত্র বলছে, পদায়নে রাজনৈতিক ও প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য রক্ষার জটিলতাই প্রধান বাধা।
একটি দলের আপত্তি, চুক্তিভিত্তিকদের মেয়াদ বিবেচনা, এবং নির্বাচনের আগে প্রশাসনকে স্থিতিশীল রাখার কৌশল—সবকিছু মিলিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে বিলম্ব হচ্ছে।
সূত্র আরও জানায়,
যদি স্বরাষ্ট্র সচিব নাসিমুল গণিকে নিয়োগ দেওয়া হয়, তাহলে অন্তত এক সপ্তাহের জন্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের কোনো কর্মকর্তা “চলতি দায়িত্বে” জনপ্রশাসন সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন।
কারণ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার কিছু অসমাপ্ত কাজ রয়েছে এবং তার স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণেও সময় লাগতে পারে।
প্রশাসনে অস্থিরতা ও জনমতের চাপ
বিগত দুই দশকে জনপ্রশাসন সচিবের পদ এতদিন খালি থাকার নজির নেই।
তাই প্রশাসনের অভ্যন্তরে অনিশ্চয়তা ও অস্থিরতা দিন দিন বাড়ছে।
বিশেষ করে আসন্ন নির্বাচনের প্রাক্কালে প্রশাসনিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা এখন সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
একজন সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন,
“জনপ্রশাসন সচিব শুধু প্রশাসনের নেতা নন, তিনি সরকারের নীতি বাস্তবায়নের কেন্দ্রবিন্দু।
এই পদে দীর্ঘ সময় শুন্যতা পুরো রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর প্রভাব ফেলে।”
সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ে এখন চলছে হিসাব-নিকাশ—
যোগ্যতা, সিনিয়রিটি, রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা ও অভিজ্ঞতা—সব দিক বিবেচনা করে কে হবেন পরবর্তী জনপ্রশাসন সচিব, তার উত্তর পেতে হয়তো আর অপেক্ষা কয়েক দিনের।
পাঠকের মন্তব্য