প্রথম মহাযুদ্ধের পর ব্রিটিশরা যখন ফিলিস্তিন শাসনের দায়িত্ব নেয়, তখন সেখানকার মানুষের মতামতকে কোনো গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। ঠিক ১০০ বছর পর, আবারও ইতিহাস যেন পুনরাবৃত্তি হলো। এবার ওয়াশিংটনের হোয়াইট হাউসে বসে হাতে গোনা কিছু মানুষ সিদ্ধান্ত নিলেন—গাজা ফিলিস্তিনের জনগণের হাতে থাকবে না, বরং আন্তর্জাতিক অন্তর্বর্তী প্রশাসনের অধীনে চলবে।
প্রস্তাবের রূপরেখা
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০ দফা শান্তি প্রস্তাব ঘোষণা করেছেন, যার নেতৃত্বে থাকবেন সাবেক ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ার এবং পরিচালনা বোর্ডের প্রধান হিসেবে থাকবেন ট্রাম্প নিজেই। কিন্তু সেই বোর্ডে বা প্রশাসনে গাজাবাসীর কোনো প্রতিনিধি থাকবেন না।
গাজার প্রশাসনে হামাসকে কোনোভাবেই স্থান দেওয়া হবে না। তাদের নিরস্ত্র করা হবে এবং ভবিষ্যতে রাজনৈতিক ভূমিকায় দেখা যাবে না। নিরাপত্তার দায়িত্বে আনা হবে বহিরাগত সেনা ও পুলিশ। আর প্রশাসনিক কাজ সামলাবেন নির্বাচিত টেকনোক্র্যাট ফিলিস্তিনিরা, যাদের জনগণ বেছে নেবেন না বরং বোর্ড কর্তৃক নিয়োগ দেওয়া হবে।
স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বপ্ন—আকাঙ্ক্ষা নাকি প্রতারণা?
ট্রাম্পের পরিকল্পনায় স্বাধীন ফিলিস্তিনের প্রসঙ্গ এসেছে বটে, তবে বাস্তবায়নের কোনো সময়সীমা বা সুনির্দিষ্ট রূপরেখা নেই। বলা হয়েছে, পশ্চিম তীরের ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষকে ঢেলে সাজাতে হবে। সেটি যথাযথভাবে সাজানো হলো কি না—তার সনদপত্র দেবে এই নতুন বোর্ড। অর্থাৎ চূড়ান্ত অনুমোদন ইসরায়েলের হাতে।
নেতানিয়াহু বহুবার বলেছেন তিনি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র হতে দেবেন না। পরিকল্পনার ভেতর তাই স্বাধীনতার প্রসঙ্গ থাকলেও তা কেবল কাগুজে প্রতিশ্রুতিই থেকে যাচ্ছে।
সমালোচনা ও প্রতিক্রিয়া
বিভিন্ন আরব ভাষ্যকার এই প্রস্তাবকে নতুন ঔপনিবেশিক শাসনের কৌশল বলে অভিহিত করেছেন। আল কুদস আল-আরাবি লিখেছে, এটি জাতিসংঘ নয়, বরং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মতো একটি কাঠামো। লেবাননের সাংবাদিক রাশিদা দেরঘাম বলেন, মনে হচ্ছে ট্রাম্প একটি দেউলিয়া করপোরেশনের মতো গাজাকে ম্যানেজ করছেন।
জর্দানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মারওয়ান মুয়াশের মতে, এটি কোনো শান্তি পরিকল্পনা নয়, বরং ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার অস্বীকার করে তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখার কৌশল।
গাজার মানবিক বাস্তবতা
আজকের গাজা যেন যুদ্ধবিধ্বস্ত এক কবরস্থান। অবরোধ, বোমাবর্ষণ আর গণহত্যায় লক্ষাধিক শিশু অনাহারে, হাজারো পরিবার গৃহহীন। এই প্রস্তাব তাদের প্রকৃত স্বাধীনতা এনে দিচ্ছে না, বরং জীবনযাত্রার নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে কেবল একটি ভিন্ন ধরনের শাসন চাপিয়ে দিচ্ছে।
গাজার মানুষের সবচেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা—নিজস্ব রাষ্ট্র, নিজস্ব পতাকা ও স্বাধীন সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। কিন্তু বারবার তাদের সেই স্বপ্ন কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। আন্তর্জাতিক শক্তিরা হয়তো শান্তির নামে যুদ্ধবিরতি চাইছে, কিন্তু ফিলিস্তিনিদের কাছে শান্তি মানে শুধু যুদ্ধ বন্ধ হওয়া নয়, বরং মুক্তির স্বাদ পাওয়া।
উপসংহার
নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, নেতানিয়াহুর সব দাবিই এই পরিকল্পনায় বাস্তবায়িত হয়েছে। স্বাধীন ফিলিস্তিনের স্বপ্ন কেবল একটি সুখকল্পনা মাত্র। গাজার মানুষ তাই আবারও শুনছে, “ড্রিম অন”—স্বপ্ন দেখে যাও।
তবুও কেউ কেউ বলছেন, যদি অন্তত গণহত্যা বন্ধ হয়, তবে এটিও আংশিক স্বস্তি। প্রশ্ন হলো—কবরের শান্তি কি আদৌ শান্তি?
পাঠকের মন্তব্য