রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের মৌখিক পরীক্ষায় নেকাব খুলতে চাপ প্রয়োগের অভিযোগ ঘিরে এক অস্বস্তিকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঘটনাটি শুধু একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে নয়, বরং বৃহত্তর পরিসরে নারী শিক্ষার্থীদের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা ও শিক্ষার নিরাপদ পরিবেশ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
বুধবার (২৪ সেপ্টেম্বর) দুপুরে বিভাগের পক্ষ থেকে প্রকাশিত এক আনুষ্ঠানিক বিবৃতিতে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের বিভাগীয় প্রধান আরা তানজিয়া ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন,
“২৩ সেপ্টেম্বর মৌখিক পরীক্ষায় হিজাব ও নেকাব নিয়ে যে অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা ঘটেছে তার জন্য আমরা বিভাগের পক্ষ থেকে দুঃখপ্রকাশ করছি। এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে এবং শিক্ষার্থীদের উপর কোনো প্রভাব যেন না পড়ে সে বিষয়ে বিভাগ সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে।”
ঘটনাটির বিবরণ
মঙ্গলবার বিভাগটির ১৫তম আবর্তনের চূড়ান্ত মৌখিক পরীক্ষায় এক নারী শিক্ষার্থীকে নেকাব খোলার নির্দেশ দেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বহিরাগত সদস্য নুরুল কাইয়ুম। শিক্ষার্থী এ অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করলে অভিযোগ ওঠে যে, ভাইভা বোর্ডের আরেক সদস্য ও বিভাগের শিক্ষক মো. ইউসুফ তাকে ফেল করিয়ে দেওয়ার হুমকি দেন।
যদিও বোর্ড সভাপতি ও সহযোগী অধ্যাপক ড. মো. মনিরুজ্জামান দাবি করেন—
“শিক্ষার্থীকে নেকাব খুলতে বলা হয়েছিল; তবে খোলেনি, তাই নেকাব পরেই ভাইভা নেওয়া হয়।”
অন্যদিকে অভিযুক্ত সহকারী অধ্যাপক মো. ইউসুফ বলেন—
“আমি কাউকে কোনো হুমকি দিইনি। আর নম্বর আমার হাতে নেই। আমি শুধুই সদস্য।”
মানবিক দৃষ্টিকোণ
একজন শিক্ষার্থীর আত্মমর্যাদা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও নিরাপত্তার অনুভূতি শিক্ষার পরিবেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শিক্ষা কেবল জ্ঞান অর্জনের ক্ষেত্র নয়, এটি মানবিক মূল্যবোধ চর্চার স্থানও। নেকাব বা হিজাব ব্যক্তির বিশ্বাসের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত। পরীক্ষার নামে বা শিক্ষা কার্যক্রমের নামে কারও বিশ্বাসে আঘাত দেওয়া এক ধরনের মানসিক চাপ তৈরি করে, যা শিক্ষার মৌলিক নীতির পরিপন্থী।
এই ঘটনার পর শিক্ষার্থীদের মধ্যে আতঙ্ক ও ক্ষোভ দেখা দিয়েছে। অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন— নারী শিক্ষার্থীদের পোশাক ও বিশ্বাস নিয়ে প্রশ্ন তোলার অধিকার কারো আছে কি না। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যে নিরাপদ ও সমান পরিবেশের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়, এ ঘটনা সেটির সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
ভবিষ্যৎ করণীয়
বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের দায়িত্ব হলো শিক্ষার্থীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা এবং তাদের মর্যাদাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া। দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি রোধে কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন করা জরুরি। একইসঙ্গে শিক্ষক ও পরীক্ষকদের জন্য সংবেদনশীলতা ও মানবিক মূল্যবোধ বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন।
উপসংহার
এই ঘটনার পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। শুধুমাত্র পাঠদান বা পরীক্ষার মাধ্যমে নয়, বরং মানবিক মর্যাদা রক্ষা, বৈচিত্র্যের প্রতি সম্মান এবং নিরাপদ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো প্রকৃত অর্থে জ্ঞানের বাতিঘর হয়ে উঠতে পারে।