জাতীয় ঐকমত্য কমিশন চলতি সপ্তাহেই বহুল আলোচিত জুলাই জাতীয় সনদ চূড়ান্ত করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। কমিশন জানিয়েছে, আগামী বৃহস্পতিবারের মধ্যে চূড়ান্ত খসড়া রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে পাঠানো হবে। তবে বাস্তবায়নের পদ্ধতি এবারও সনদে অন্তর্ভুক্ত থাকছে না, যা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ভিন্নমত আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
সনদ প্রণয়নের পটভূমি
এ বছরের জুলাই মাসে ছয়টি সংস্কার কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে একটি প্রাথমিক খসড়া তৈরি করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। প্রাথমিক খসড়া ৩০টি দলের কাছে পাঠানো হয়, যাদের মধ্যে ২৯টি দল লিখিত মতামত প্রদান করে। সেই মতামতের ভিত্তিতে ১৬ আগস্ট ‘সমন্বিত খসড়া’ প্রস্তুত করা হয়।
তবে বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে ব্যাপক মতভেদ থাকায় সনদ চূড়ান্ত করা বিলম্বিত হয়। কমিশনের কার্যপরিধি অনুযায়ী, তাদের মূল দায়িত্ব হলো রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্য তৈরি করা এবং সংস্কার প্রস্তাবগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে সুপারিশ আকারে পেশ করা।
দলগুলোর ভিন্নমত
সংস্কার বাস্তবায়নের উপায় নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো এখনো বিভক্ত:
-
বিএনপি : সংবিধান সংশোধনী সংসদের মাধ্যমে করা উচিত।
-
জামায়াতে ইসলামী : গণভোট বা রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়ন।
-
এনসিপি (জাতীয় নাগরিক পার্টি) : নতুন একটি গণপরিষদ গঠনের প্রস্তাব দিয়েছে।
-
সিপিবি, বাসদ, গণফোরামসহ বাম দলগুলো : কেবল যেসব বিষয়ে সর্বসম্মত ঐকমত্য হয়েছে, সেগুলোই সনদে রাখা উচিত।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব আহমদ আবদুল কাদের বলেন,
“আমরা মনে করি সময়সাপেক্ষ গণভোটের পরিবর্তে রাষ্ট্রপতির প্রোক্লেমেশনের মাধ্যমে বাস্তবায়নই এখন বাস্তবসম্মত হবে। তবে এর পরের সংসদ অধিবেশনে অবশ্যই এগুলো রেটিফাই করতে হবে।”
কমিশনের অবস্থান
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন,
“চূড়ান্ত খসড়ায় বাস্তবায়নের উপায় উল্লেখ করা হবে না। দলগুলোর মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে একটি সুপারিশ আলাদা করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে পেশ করা হবে।”
তাঁর মতে, কমিশনের কার্যপরিধিতে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নির্ধারণের বিষয়টি ছিল না। তাই এটিকে সরাসরি সনদের অংশ করলে কোনো কোনো দল সই করতে অস্বীকৃতি জানাতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাস্তবায়নের উপায় বাদ দিলে সনদ একটি নৈতিক অঙ্গীকারনামা হিসেবেই থেকে যেতে পারে। তবে কমিশনের কৌশলটি বাস্তবসম্মতও বটে।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন, বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়েই দলগুলোর বিভাজন তীব্র। এটি চূড়ান্ত খসড়ায় রাখলে পুরো প্রক্রিয়া ব্যাহত হতে পারে। এখন কমিশনের কাজ হবে—সব দলের মতামত ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ একত্র করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে কার্যকর বাস্তবায়ন প্রস্তাব দেওয়া।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ
চূড়ান্ত খসড়া দলগুলোর কাছে পাঠানোর পর প্রধান চ্যালেঞ্জ হবে তাদের সই পাওয়া। যদি অধিকাংশ দল এতে সই করে, তবে এটি দেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক বিরল ঐকমত্যের দলিল হয়ে উঠবে।
তবে ভিন্নমত অব্যাহত থাকলে সনদ কার্যকর করার পথ আরও জটিল হয়ে উঠবে। বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন, যদি এই দলিল বাস্তবায়নের কোনো কার্যকর রূপরেখা না থাকে, তবে তা শুধুই প্রতীকী দলিল হয়ে থাকবে।
উপসংহার
জুলাই জাতীয় সনদ এখন চূড়ান্তকরণের দ্বারপ্রান্তে। তবে বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে দলগুলোর মতবিরোধই হয়ে উঠেছে সবচেয়ে বড় বাধা। কমিশন আপাতত সনদ চূড়ান্ত করে অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বাস্তবায়ন পদ্ধতি সুপারিশ করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এখন সবার দৃষ্টি রাজনৈতিক দলগুলোর ওপর—তারা কি সত্যিই এক টেবিলে এসে একটি অভিন্ন সনদে সই করতে রাজি হবে? নাকি ভিন্ন মতের কারণে আবারও দেশের রাজনৈতিক ঐকমত্য হাতছাড়া হয়ে যাবে?
পাঠকের মন্তব্য