জাহিদুজ্জামান সৈয়দ
২০২৫ সালের জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে বাংলাদেশ প্রত্যক্ষ করেছে এক ঐতিহাসিক রাজনৈতিক অভ্যুত্থান, যা পরবর্তীতে ‘জুলাই গণবিপ্লব’ নামে পরিচিতি লাভ করে। এটি ছিল শুধু একটি ছাত্র-আন্দোলন নয়; বরং ছিল এক দীর্ঘকালীন দুঃশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের নিরবিচার, নির্ভীক রুখে দাঁড়ানোর এক মহাকাব্যিক মুহূর্ত।
আজ, এক মাস পেরিয়ে এসে, দেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে ঘটেছে নাটকীয় পরিবর্তন। শেখ হাসিনার ১৪ বছরের একনায়কতান্ত্রিক শাসনের অবসান ঘটিয়ে, তাঁর দীর্ঘকালীন ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল গণভবনকে রূপান্তরিত করা হয়েছে ‘জুলাই বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর’-এ। এটি এখন শহীদদের স্মৃতি রক্ষা এবং ইতিহাসের নির্মোহ পাঠের জন্য উন্মুক্ত এক প্রতীকী স্থান।
আন্দোলনের সূচনা ও প্রথম ধাক্কা: রংপুরের ছাত্র হত্যাকাণ্ড
২৫ জুন ২০২৫, রংপুরে ছাত্র নেতা আবু সাঈদ-কে রাজপথে সরাসরি গুলি করে হত্যা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এই হত্যাকাণ্ড ছিল আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ। সামাজিক মাধ্যমে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে ঘটনাটি, এবং উত্তরবঙ্গে ছাত্রছাত্রীদের মাঝে চরম ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
নটরডেম কলেজ ছাত্র ও ঢাকার বিস্ফোরণ
২৯ জুন, ঢাকার অন্যতম মর্যাদাসম্পন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান নটরডেম কলেজের ছাত্র রায়হান জামান সরকারপন্থী ছাত্র সংগঠনের হামলায় নির্মমভাবে নিহত হয়। তিনি ছিলেন শিক্ষা সংস্কারের দাবিতে সুশৃঙ্খল অবস্থান কর্মসূচির একজন সংগঠক। এই হত্যাকাণ্ড ছিল ঢাকায় ছাত্র-আন্দোলনের জোয়ারের সূচনা।
মুগ্ধ হত্যাকাণ্ড ও জন-আন্দোলনের রূপান্তর
১ জুলাই, খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র মুগ্ধ রহমান, তীব্র গরমে পানির দাবিতে অবস্থান নেয়া শিক্ষার্থীদের জন্য নিজ হাতে পানি এনে বিতরণের সময় পুলিশ গুলিতে নিহত হন। তাঁর মৃত্যু ছিল প্রতীকী; যেন ‘মানবিকতা’কেই গুলি করে হত্যা করা হয়। এই ঘটনার পর আন্দোলন আর শুধুই ছাত্রদের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকেনি—পড়ন্ত বিকেলে নগরজুড়ে সাধারণ মানুষও রাস্তায় নেমে আসে।
শেখ হাসিনার নির্বাসন: ক্ষমতা হারানোর ট্র্যাজেডি
৩ জুলাই মধ্যরাতে, কূটনৈতিক চাপে এবং সেনাবাহিনীর নিরপেক্ষ অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে, শেখ হাসিনা গোপনে গণভবন ত্যাগ করেন। জানা যায়, তিনি প্রথমে ভারতীয় দূতাবাসে আশ্রয় নেন এবং পরে একটি বিশেষ বিমানে ওমানে পাড়ি জমান। সেখানে তিনি বর্তমানে রাজনৈতিক আশ্রয়ে আছেন।
বিদেশি গণমাধ্যম যেমন The Guardian, Al Jazeera, এবং DW বিষয়টিকে “Southeast Asia’s biggest democratic youth uprising of the decade” বলে আখ্যা দেয়।
‘জুলাই বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর’: প্রতীকী রূপান্তর
সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাসভবন ‘গণভবন’কে, ৫ আগস্ট ২০২৫-এ আনুষ্ঠানিকভাবে ‘জুলাই বিপ্লব স্মৃতি জাদুঘর’ ঘোষণা করা হয়। এখানে থাকছে:
● শহীদদের ব্যবহৃত শেষ বস্তুসমূহ
● ভিডিও ফুটেজ ও চাক্ষুষ সাক্ষ্য
● ছাত্রনেতাদের ব্যক্তিগত ডায়েরি, চিঠিপত্র
● সেই সময়কার সামাজিক মাধ্যম পোস্ট ও পোস্টার সংরক্ষণাগার
● “অন্ধকারের দিনপঞ্জি” নামে একটি স্থায়ী প্রদর্শনী যেখানে গণমাধ্যমের সেন্সরশিপ ও নিপীড়ন তুলে ধরা হয়েছে
আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া ও ভবিষ্যতের দিশা
জাতিসংঘ, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলো বাংলাদেশের বর্তমান পরিবর্তনকে ইতিবাচক বলেই দেখছে। জাতিসংঘ মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেন,
“Bangladesh has proven once again that people’s power, when combined with moral courage, can rewrite history.”
উপসংহার
‘জুলাই বিপ্লব’ কেবল একটি তারিখ নয়, এটি এক মানসিক, রাজনৈতিক ও নৈতিক মুক্তির নাম। শেখ হাসিনার গণভবন থেকে স্মৃতি জাদুঘরে রূপান্তর আমাদের মনে করিয়ে দেয়—কোনো শক্তিই চিরকাল স্থায়ী নয়, যদি সেটি ন্যায়ের ভিতের উপর প্রতিষ্ঠিত না হয়। এবং এও শিখিয়ে দেয়, সত্যিকারের গণতন্ত্র আসে মানুষের ঘাম, রক্ত ও আত্মত্যাগের বিনিময়ে।
পাঠকের মন্তব্য